২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

হাজার ইয়াবা কারবারি ধরাছোঁয়ার বাইরে

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৩০ অপরাহ্ণ, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কক্সবাজারের টেকনাফে ২৪ গডফাদারসহ ১০২ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করলেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে ৯৯৬ জন। তাদের কেউ কেউ বীরদর্পে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কেউ কেউ দেশ-বিদেশে পালিয়ে থেকে ইয়াবার কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত টপ টেন ইয়াবা গডফাদারের বেশিরভাগই আত্মসমর্পণ না করায় এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। স্থানীয়রা বলছেন, সরকারের মাদকবিরোধী তৎপরতায় অপরাধীরা আপাতত কিছুদিন বিরত থাকলেও পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পুনরায় অপরাধ শুরু করবে।

তাদের মতে, আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মাদক কারবারিদের সুরক্ষার লাইসেন্স দেয়া হল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলেছে, যারা আত্মসমর্পণ করেনি। তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে।

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা পুলিশের তালিকায় থাকা ১ হাজার ১৫১ ইয়াবা ব্যবসায়ী ও গডফাদারের মধ্যে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মারা গেছে ৫৩ জন, আত্মসমর্পণ করেছে ১০২ জন।

তাছাড়া ৪৪ গডফাদারসহ ৯৯৬ ইয়াবা কারবারি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গডফাদারদের তালিকার ২ নম্বরে থাকা ইয়াবা ডন সাইফুল করিম দুবাইয়ে অবস্থান করছে।

তার রয়েছে বিশাল বাহিনী ও অস্ত্র ভাণ্ডার। সাইফুল করিম শতাধিক অনুসারী নিয়ে আত্মসমর্পণের আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেনি। নুরুল হক ভুট্টোও গা ঢাকা দিয়ে আছে। গডফাদার ও কারবারিদের যারা বাইরে আছে তাদের হেফাজতে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

তারা আত্মসমর্পণে রাজি হলে আবারও সুযোগ দেয়া হতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্তদের বাইরে কক্সবাজার ও টেকনাফে আরও প্রায় ৫শ’ ইয়াবা কারবারি ও গডফাদারের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তাদের ‘হোয়াইট কালার’ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে এখন যাচাই-বাছাই চলছে। এ তালিকায় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী এবং আইনজীবী রয়েছে। আত্মসমর্পণে রাজি হলে তাদেরও সুযোগ দেয়া হবে। আর রাজি না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে শনিবার যে ১০২ জন আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা হয়েছে। মামলায় সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই আবদুস শুকুরকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।

অপর ভাই আমিনুর রহমানকে করা হয়েছে ২নং আসামি। এ দু’জনসহ যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের প্রত্যেকের মাথায় মৃত্যুদণ্ডের খক্ষ। ২০১৮ সালে সংশোধন করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কারও কাছে ২০০ গ্রাম ইয়াবা পাওয়া গেলেই তার মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে।

একটি ইয়াবার ওজন শূন্য দশমিক এক গ্রাম। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির কাছে যদি দুই হাজার বা তার চেয়ে বেশি ইয়াবা উদ্ধারের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। শনিবার আত্মসমর্পণকারীরা সাড়ে তিন লাখ ইয়াবা জমা দিয়েছে।

এগুলোর ওজন অন্তত ৩৫ কেজি। গড় হিসাব করলে মাথাপিছু ইয়াবার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪৩ গ্রামেরও বেশি। এছাড়া উদ্ধার করা হয়েছে ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আছে একাধিক মামলা।

যদি বিশেষ কোনো সুযোগ না দেয়া হয় তবে তাদের অনেককেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশ্বাসে যেহেতু তাদের আত্মসমর্পণ করানো হয়েছে, সেক্ষেত্রে এ দুই মামলায় নমনীয়তা দেখাবে সরকার।

পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, সুন্দরবনের আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের মধ্যে যারা হত্যা, ধর্ষণসহ সিরিয়াস অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের সাজা ভোগ করেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হয়েছে।

কক্সবাজারে আত্মসমর্পণকারীদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। যারা সিরিয়াস ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত তাদের সাজা ভোগ করতেই হবে। তাছাড়া স্বাভাবিক যে আইনি প্রক্রিয়া তাদের বিরুদ্ধে সেগুলো চলমান থাকবে।

যেসব মামলা তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে, সেগুলো আইনি নিয়মে সমাধান হবে। অস্ত্র ও মাদক আইনে যে দুটি মামলা হয়েছে, তারও আইনি প্রক্রিয়া সচল থাকবে। যেহেতু তারা আত্মসমর্পণ করেছে, সে কারণে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি নমনীয়ভাবে দেখবে সরকার। আর তালিকাভুক্তদের মধ্যে যারা আত্মসমর্পণে আসেনি তারা পরে আত্মসমর্পণ করতে চাইলে সব ধরনের সহযোগিতা করবে পুলিশ।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে আইনি পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেবে পুলিশ।’

মাদক কারবারিদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমাদের আইন ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বিচারিক প্রক্রিয়ায় এদের শাস্তির সম্ভাবনা খুবই কম।’

আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘এ ধরনের প্রক্রিয়া সমন্বিত পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে হওয়া উচিত ছিল। কারণ এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন কর্নার থেকে প্রশ্ন উঠেছে। কিসের ভিত্তিতে তালিকা হল? তাদের কী সুযোগ দেয়া হচ্ছে? এগুলো স্পষ্ট করা উচিত ছিল। কারণ কিছুদিন আগে জলদস্যু আত্মসমর্পণ প্রশংসা পেয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়া ঠিক করা উচিত ছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নিহাল করিম বলেন, ‘আত্মসমর্পণ করিয়ে মাদক পাচার বন্ধ করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ১০২ জন আত্মসমর্পণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি লোক দেখানো কিনা এ নিয়ে সংশয় রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গডফাদারদের অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের আইনের আওতায় আনা এবং মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে মাদক পাচার ও বেচাকেনা কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

ইতিমধ্যে মাদক কারবারিদের হুশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, ‘যারা আত্মসমর্পণ করেনি তাদের ছাড় নেই। মাদক কারবারিরা হয় আত্মসমর্পণ করবে, নয় অভিযানের মাধ্যমে কঠিন পরিণতি ভোগ করবে।’

আত্মসমর্পণের বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের সঙ্গে পুলিশের শর্তই ছিল আত্মসমর্পণের পরে যে মামলা হবে, সে মামলার বিষয়ে সরকার একটু সদয় দৃষ্টি দেবে।

তবে আগে থেকে যাদের নামে মামলা আছে, সেসব মামলা মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘তাদের সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাই করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে পাঠাব। যাচাই-বাছাই করার পর প্রয়োজনে মামলা হবে। আমাদের শর্তেই বলা আছে, আমরা সিআইডির মানি লন্ডারিং ইউনিট, এনবিআর ও দুদকে তাদের সম্পদবিবরণী পাঠাব। ভবিষ্যতে ছাড়া পাওয়ার পর যদি তারা মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয় তবে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ধরাছোঁয়ার বাইরে যেসব গডফাদার : ৭৩ ইয়াবা গডফাদারের মধ্যে এখনও ৪৪ জন ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এরমধ্যে কক্সবাজার-৪ আসনের (উখিয়া-টেকনাফ) সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারিদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ অনেক পুরনো।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় এক নম্বরে আছে তার নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা টেকনাফের শীর্ষ মানব পাচারকারীর তালিকাতেও তার নাম ছিল। বদির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।

মাদকবিরোধী অভিযানের আগে পাঁচটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার সমন্বয়ে মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের একটি তালিকা তৈরি করে সরকার। সেই তালিকায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবদুর রহমান বদির নাম রয়েছে।

তালিকায় বদির নাম থাকলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘মাদকের সঙ্গে বদির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী আমরা পাইনি। নাম থাকলে তো চলবে না। প্রমাণ তো করতে হবে তিনি অপরাধী।’

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২২ মে সচিবালয়ে নিজ দফতরে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ থাকার পরও আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমাদের কাছে আছে। আমরা সেই অভিযোগগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছি। বদিসহ অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে আপনাদের কাছেও কোনো তথ্য থাকলে আমাদের দিন। বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তথ্য-প্রমাণ নাই।’

এদিকে সোমবার জাতীয় সংসদেও বদিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অনেকের ধারণা, বদির বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারিদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ থাকার কারণেই মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।

এছাড়া তালিকার দুই নম্বরে থাকা ইয়াবা চোরাচালানের মূল হোতা হাজী সাইফুল করিম, টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, তার ছেলে সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিন, তার ভাই বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন, সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, জালিয়া পাড়ার জাফর আলম প্রকাশ টিটি জাফর, শাহপরী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান ইয়াহিয়া, উখিয়া গুয়ালিয়ার ইউপি সদস্য মোস্তাক আহমদ, টেকনাফ নাজির পাড়ার নুরুল হক ভুট্টো, কক্সবাজার শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার কাশেম আনসারী, একই এলাকার আবুল কালাম ও তার ভাই বশির আহমদ, বাস টার্মিনাল এলাকার বার্মাইয়া আবু নফর, চকরিয়া পৌর যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম সোহেল, মহেশখালী পুটিবিলার মৌলভী জহির উদ্দীন, পৌরসভা সিকদার পাড়ার সালাহ উদ্দীন, রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন কোম্পানী, মিঠাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়রম্যান ইউনুচ ভুট্টোসহ অনেকেই অধরা। শনিবারের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, তার ছেলে শাহজাহান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিন, মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও পৌর কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

 

 

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন