২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

অর্থকষ্টে ছাত্রলীগ নেতা ‘সমর দাস’র মৃত্যু, স্মরণসভার ব্যানারে ৩ লাখ টাকায় ভূরিভোজ (!)

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:০০ অপরাহ্ণ, ০১ মার্চ ২০২১

শাকিব বিপ্লব, বরিশাল:: নাটক-চলচ্চিত্রের পরতে পরতে থাকে রোমান্স, মান-অভিমান, সংঘাত ও ত্যাগসহ পরিপূর্ণ এক থিলার। অনুরুপ রাজনীতির পিচ্ছিল পথেও থাকে সংঘাত প্রতিহিংসা ত্যাগ ও অবহেলার নানামুখী কাহিনী। যেমন রাজনীতিতে চরম ত্যাগ শিকার করেও মৃত্যুপূর্ব সমর দাসের যথার্থ মূল্যায়ন মেলেনি। বরং অবহেলায় বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক এই মেধাবী ছাত্রনেতা দুর্বিসহ অর্থকষ্টে একপর্য়ায়ে বিনা চিকিৎসায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন ত্যাগের মঞ্চ থেকে। কাকতালীয়ভাবে এবার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে দলীয়ভাবে সেই ছাত্রনেতার স্মরণে আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনীয়তা বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কর্ণকুহরে পানি গেলো। তাও সমষ্টিগতভাবে নয়, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও নগর আ’লীগের সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এই আনুষ্ঠানিকতার উদ্যোগ নেন। তারই আলোকে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী রোববার ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বরিশাল ক্লাবে অনুষ্ঠিত স্মরণসভার আদলে বিপুল অঙ্কের ব্যয়ে ভূরিভোজে অংশ নেয় প্রায় দুই সহস্রাধিক দলীয় নেতা-কর্মী। যে নেতা জীবনদশায় ত্যাগের মূল্যায়ন তো দূরের কথা, দূরারোগে আক্রান্ত হওয়ার পর আর্থিক সহায়তা জোটেনি। বিনা চিকিৎসায় মৃত সেই সমর দাসের স্মরণসভা এ যেন রাজনীতির কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্রের প্রতিচ্ছবি।

এধরনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে, খোদ দলীয় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। যদিও সাদামাটা চোখে বিষয়টি মূল্যায়ন করলে এই উদ্যোগ একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দলের সংক্ষুব্ধ নেতৃবৃন্দের অনুভূতি অনুধাবন করে বলছে, সমর দাসের মৃত্যুর তিন বছর পেরোলেও দলীয়ভাবে এই মেধাবী ছাত্রনেতাকে স্মরণে দলীয় কোনো উদ্যোগ না থাকাটা ছিলো বেদনাদায়ক। বলা যায়, মৃত্যুর পরেও নেতৃবৃন্দের অন্তরে তিনি ছিলেন অবহেলিত নেতা। কিন্তু এবার কেনো ব্যতিক্রম হলো, সেই প্রশ্নে তাদের ভাবনা সম্ভাবত সাদিক আব্দুল্লাহ’র একদিকে প্রশ্নবিদ্ধ নেতৃত্ব অন্যদিকে ক্ষমতার টালমাটাল সন্ধিক্ষণে এই রাজনীতিবিদ নিজেকে ব্যতিক্রমীভাবে উপস্থাপন এবং অনুসারীদের একত্রিত করে তার অবস্থান শক্তপোক্ত করতেই প্রয়াত ছাত্রনেতা সমর দাসের স্মরণসভার আনুষ্ঠানিকতা ব্যাপকতায় রুপ দেন। অর্থাৎ এখানেও রাজনীতিনর ছলাকলা নিহিত রয়েছে। শুধু এই স্মরণসভা নয়, ইদানিং কোনো ইস্যুবিহীন কর্মসূচিতে মেয়র সাদিকের সমর্থনে শহরে মোটরসাইকেল শো ডাউন ও মিছিল থেকেই সমর দাসকে স্মরণে উদ্ভাবিত প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলে সংক্ষুব্ধদের অভিমত।

উল্লেখ্য, বরিশাল সরকারী কলেজের সাধারণ সম্পাদক এবং ল কলেজের সম্পাদক থেকে মহানগরে কোনোভাবে স্থান পাওয়া সমর দাস গত ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যু পরবর্তী দুটি বছর তাকে স্মরণ করা হয় পারিবারিক উদ্যোগে নিজ গৃহ ও ধর্মীয় উপাসনালয় মন্দিরে। এবারও সমর দাসের ছোট ভাই একসময়ের ছাত্রলীগের ডাকসাইডের নেতা বাপ্পা দাস প্রয়াত ভাইকে পূর্বরুপে স্মরণে আনুষ্ঠানিক আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। দলীয় একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সমর দাসের মৃত্যুবার্ষিকীর পারিবারিক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে।

সমর দাসের বাড়ির সন্নিকটে কালীবাড়ি সড়কে মেয়রের বাসভবনে বাপ্পা দুই দিন আগে বাপ্পা দাস নিমন্তন্ন অবহিত করতে গেলে নগর আ’লীগরে সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহ ঘরোয়া অনুষ্ঠান পালনের ধারাবাহিকতা শুনে আফসোস করেন। একপর্যায়ে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের বাইরে ঘটা করে স্মরণসভা এবং খানাপিনার আয়োজনের সার্বিক ব্যয়ভার তিনি বহন করার সম্মতি জানিয়ে অনুষ্ঠানের সময়সূচি নির্ধারন করেন।

বাপ্পা দাস ‘বরিশালটইমস’কে এই তথ্য দিয়ে জানান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ আন্তরিকভাবে তার ভাই সমর দাসের স্বর্গীয় আত্মার শান্তি কামনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সকল স্তরের দলীয় নেতা-কর্র্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে তিনি উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি সমর দাসের সকল আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের অনুষ্ঠানে শামিল করতে বাপ্পা দাসকে অনুরোধ রাখেন।

ওই সূত্রটি জানায়, তাৎক্ষণিকভাবে মেয়র ও নগর আ’লীগের শীর্ষ নেতা অনুষ্ঠান সফলে তার রাজনৈতিক বিশ্বস্ত সহোচর নিরব হোসেন টুটুলকে দায়িত্ব দেন। মহানগর আ’লীগের বাণিজ্য বিষয়ক সস্পাদক নিরব হোসেন টুটুল ২৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল ক্লাবে সমর দাসের স্মরণে অনুষ্ঠানের কর্মপন্থা নির্ধরণ এবং খাবারের ভেন্যু কি হবে তা মেয়রকে অবহিত করে বাজেট নির্ধারণ করা হয় সেক্ষেত্রে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় এবং টার্গেট নেওয়া হয়, অন্তত হাজারখানেক অতিথির উপস্থিতি ঘটানো। সেই অনুযায়ী গতকাল রবিবার মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ সমর্থিত আ’লীগের জেলা ও মহানগরের নেতৃবৃন্দসহ অঙ্গ সংগঠন এবং সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলররা দুপুর গড়ানোর আগেই বরিশাল ক্লাবে উপস্থিত হতে থাকেন। নিরব হোসেন টুটুলের ব্যবস্থাপনায় গোটা অনুষ্ঠান তদারকি করেন স্বয়ং মেয়র।

বাপ্পা দাস নিশ্চিত করেন, তার স্বজনরা ছাড়াও বন্ধু এবং কালীবাড়ির পড়শিরা অনুষ্ঠানেঅংশ নেয়। সবমিলে প্রায় সহস্রাধিক লোকের অংশগ্রহণে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রয়াত নেতা সমর দাসের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু প্রয়াত এই ছাত্রনেতাকে স্মরণ করে বক্তব্যের কোন পর্ব ছিলো না। ফলে এই অনুষ্ঠানকে স্মরণসভা না বলে শ্রদ্ধার আদলে ভূরিভোজে রুপ নেয়। ফলে বিতর্ক আরেকটু প্রসারিত হয় বলে প্রতিধ্বনি শোনা যায় অনুষ্ঠান থেকে ফেরা নেতা-কর্মীদের কন্ঠে। তাদের ক্ষোভ থেকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন মেয়রের এই উদ্যোগের পিছনেও রাজনৈতিক কৌশল নিহিত রয়েছে।

এমন মন্তব্য অস্বাভাবিক নয়, বলে বিশ্লেষকদের অভিমত হচ্ছে, সমর দাস জীবদ্দশায় মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর পিতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর অনুগত ছাত্রনেতা ছিলেন। একটানা তৃতীয় মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকারের প্রথমভাগে প্রথমভাগে দীর্ঘকাল প্রয়াত আ’লীগ নেতা শওকত হোসেন হিরন প্রথম নির্বাচিত সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হওয়ার পর বিভাজনের রাজনীতিতে দুটি স্রোতধারার সৃষ্টি হয়। এইসময়কালে হিরনের একক ক্ষমতার দাপটে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ কোণঠাসা হয়ে পড়া এবং তার অনুসারীদের একটি বৃহৎ অংশ পর্যায়ক্রমে হিরণের অনুকূলে ক্ষমতার স্বাদ নিতে চলে যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন গুটিকয়েক নেতা-কর্মী, তাদের মধ্যে আ’লীগ ঘরনার সন্তান এবং পোড় খাওয়া ছাত্রনেতা সমর দাস।

রাজনীতিতে ত্যাগের নানান উদাহরণ সৃষ্টি করলেও মেধা অনুযায়ী তাকে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে মহানগর ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত করা হয়নি। এক সময়ে কঠিন দূরারোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরে পড়ে থাকলেও কোনো দায়িত্বশীল দলীয় নেতা একনজর দেখতে যায়নি বলে পারিবারিক অভিযোগ রয়েছে। নেতা হিরনের মৃত্যুর পর ভিন্ন মেরুর নেতা হিসেবে সাদিক আব্দুল্লাহর উত্থ্যান এবং স্থানীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হওয়ার গত দুটি মৃত্যুবার্ষিকী সবার অজান্তেই পালিত হয় মন্দিরে। হঠাৎ সেই প্রয়াত নেতার স্মরণে বৃহৎ পরিসরে ভূরিভোজের এই আয়োজন নিয়ে অলোচনা-সমালোচনার জায়গা নিয়েছে।

যদিও মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ’র সমর্থিতরা বলছে, রাজনীতির নানান ঘোরপ্যাঁচে সাদিক আব্দুল্লাহ প্রয়াত এই ছাত্রনেতা সমর দাসকে মূল্যায়ন করলেও মৃত্যুবার্ষিকী পালনে বিগত দুটি বছর সাংগঠনিক উদ্যোগ নিতে পারেনি বলেই এবার এই বৃহৎ আয়োজনের মূল উদ্দেশ। নিন্দুকেরা যাই বলুক, এই আয়োজন নিয়ে কুট রাজনীতির অবকাশ নেই। বিষয়টি ইতিবাচক দেখাই শ্রেয়।’

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন