৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার

অসুস্থ স্বামীর ওষুধ কিনতেই সব শেষ, নিজের ওষুধ কেনা দায়!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:০৮ অপরাহ্ণ, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩

অসুস্থ স্বামীর ওষুধ কিনতেই সব শেষ, নিজের ওষুধ কেনা দায়!

রুমা আক্তার, পাথরঘাটা(বরগুনা) প্রতিনিধি:: ছালেহা বেগম। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছে। পেটের দায়ে এ বয়সে এসেও কাজ করতে হয় তাকে। তাও আবার নারী হয়েও মাছ ধরার কাজ। সিডরে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক ছালেহা! স্বামী থেকেও যেন নেই… অনেক বছর ধরে অসুস্থ। আজও ছেলের অপোয় আছেন প্রতি মুহূর্ত।

প্রান্তিক জনপদ বাদুরতলা গ্রাম। এ গ্রামে প্রতি পরিবারই মাছ ধরার কাজ করে। এক কথায় জেলেপল্লী বলা যেতে পারে। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ছেলে বাবু ফকির আর ফিরে আসেনি। আজও ছেলের পথপানে ষাটোর্ধ ছালেহা। ছেলে নিখোজ হওয়ার পর নিজেই সংসারের হাল ধরেছেন। নদী ও খালে মাছ ধরার মতো ঝূকির কাজ করছেন সালেহা। নারী অধিকার বা মানবাধিকার বলতে কিছুই বুঝেনা সালেহাসহ এখানকার নারীরা। দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মাছ বিক্রি করতে পারছে। তাও আবার কোন কোন দিন শারীরিক অসুস্থতার কারণে ধরতে পারছে না। আবার স্বামীর অসুস্থতার ওষুধ কিনতে হয়। নিজেরও ওষুধ লাগে।

বরগুনাসহ উপকূলীয় বাসিন্দাদের জীবন চলে অতি কষ্টে। ঝড়,জ্বলোচ্ছাস ও দুর্যোগের সঙ্গে তাদের বসবাস। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে উপকূলবাসী। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মৎস্য পেশার ওপর নির্ভরশীল। জীবিকার তাগিদে অথৈ সাগরে নিয়ে অনেকেই না ফেরার দেশে চলে যান। অসহায় হয়ে পড়েন অনেকেই। সন্তান হারা হন মা-বাবা, মা-বাবা হারা হন সন্তান। এমন চিত্র প্রান্তিক জনপদে নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রান্তিকের অন্তহীন দুর্দশার সব সময় থাকে।

২০০৭ সালের ১৫ নভম্বর। উপকূল দিয়ে বয়ে যায় ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডর। পাথরঘাটার উপকূলে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়। প্রাণহানি হয় সেই সময় সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া অসংখ্য জেলে। অনেকে ভাগ্যক্রমে ফিরে আসলেও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে। আজও তাদের সন্ধান মেলেনি। সিডরের ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বাবু ফকিরের মতো অসংখ্য জেলের সন্ধান মেলেনি। বেঁচে আছে না মারা গেছে এমন প্রশ্ন রয়েছে সবার মনে। একই ট্রলারে থাকা জাকির হাওলাদার, ইসমাইল হোসেন ও হারেজ বিডিয়ারসহ প্রতিবেশি নয়জন আজও ফিরে আসেনি।

একমাত্র ছেলে মো. বাবু ফকির। স্বামী অনেক বছর ধরে অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারে না। একমাত্র ছেলের উপার্জনেই নির্ভর মা ছালেহা ও আজিজ ফকির ফকিরের সংসার। পূর্ব পুরুষের পেশা ধরে রাখতে এবং বেঁচে থাকার সাগরে মাছতো ধরতেই হবে। একমাত্র ছেলে সাগরে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। ২০০৭ সালের ভয়াল ১৫ নভেম্বর সিডরে ছালেহা বেগমের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আজও একমাত্র ছেলেকে ভুলতে পারেননি ছালেহা। প্রতি মুহূর্ত ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদেন ছালেহা।

কথা হয় ছালেহা বেগমের সঙ্গে। সিডরের আগে একমাত্র ছেলে বাবু ফকির সাগরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এ কান্না যেন একদিনের নয়, ১৬ বছর ধরেই ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে চলেছেন ছালেহা। স্বামীর অসুস্থতার কারণে নিজের ওপরই সংসারের দায়িত্ব। কাজের ফাঁকে ছেলের কথা মনে পড়লেই আলাদা জায়গায় গিয়ে কান্না করেন। কখনো কখনো নামাজ বসেও কান্না করেন। আজও ছেলের পথের দিকে তাকিয়ে আছেন ছালেহা।

ছালেহা বেগম বলেন, বাবু সাগরে যাওয়ার সময় একটি বড় পোমা (পোয়া) মাছ দিয়া গেছে খাওয়ার জন্য। আর বলে গেছে, এবার সাগর থেকে আসার সময় বড় ইলিশ মাছ নিয়া আইবে। কিন্তু ইলিশ মাছ দিয়া কি করমু, মোর পোলাডাইতো আয়নায়। বিয়া করার ১০ মাস পর সাগরে যাইয়া পোলায় আর আয়নায়। আমার ছেলে সিডরে নিখোঁজ হওয়ার কয়েকমাস পুত্রবধূর গর্ভে একটি সন্তান এলেও গর্ভেই মারা যায়।

তিনি আরো বলেন, একমাত্র পোলার কামাইতে সংসার চলতে। স্বামী কাজ করতে পারছে না। আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করি আর বনের মধ্যে খালে মাছ ধরি, তা বিক্রি করে যা পাই তা দিয়া সংসার চালাই। আমার পোলা হয়তো আর বেঁচে নেই। মনতো মানে না। আজও আমরা বুড়াবুড়ি সন্তানের অপোয় পথের দিকে তাকিয়ে আছি।

পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, সিডরের আগে এবং পরে যতগুলো বন্যা হয়েছে ওই বন্যায় নিখোজদের তালিকা করা হচ্ছে। আইনের কারণে তারা কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি এসব পরিবারদের কিছু সহায়তা দিতে।’

18 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন