২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

আমলা-রাজনীতিকদের ভয় পায় গণমাধ্যম!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৫৩ অপরাহ্ণ, ২৩ আগস্ট ২০২১

আমলা-রাজনীতিকদের ভয় পায় গণমাধ্যম!

নিয়ন মতিয়ুল >> রাজনীতির ধারক-বাহকরা যখন মত-পথ হারিয়ে অসুস্থ পথে হাঁটেন তখন গণমাধ্যমকে ভুগতে হয় ‘অপুষ্টিতে’। বিপরীতদিকে, আমলারা (প্রজাতন্ত্রের সেবক) যখন সীমারেখার বাইরে গিয়ে ‘অতিআচরণ’ শুরু করেন তখন গণমাধ্যমকে ভুগতে হয় হীনমন্যতায়। এখন আমলা আর রাজনীতিকরা যদি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মুখোমুখি দাঁড়ান, তখন কী ভূমিকা নেবে গণমাধ্যম? এমন প্রশ্নে অতি উৎসাহীরা হয়তো বলবেন, কেন, হাততালি দেবে। কেউ বলবেন, রাষ্ট্রের ‘চাকর-বাকরদের’ ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে। কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে হয়তো বলবেন, কেন, রাজনীতিকদের বাড়াবাড়িটা গণমাধ্যমের চোখে পড়ে না? সেসব নিয়েই অনুসন্ধান করবে।

বাস্তবক্ষেত্রে গেল কয়েকদিনের সংবাদপ্রবাহ দেখে মনে হয়েছে, বরিশালকাণ্ডে অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করেছে বেশিরভাগ গণমাধ্যম। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টাতেও ভেতরের রহস্য বা আসল কারণ কেউ প্রকাশ করেনি বা করতে পারেনি। চলমান বা দৃশ্যমান তথ্য ছাড়া আর কোনো বিশেষ প্রতিবেদনও দেখা যায়নি। এমনকি দু’একটি বাদে বিশেষ মতামত, কলাম বা গভীর বিশ্লেষণ জাতীয় কোনো লেখা চোখে পড়েনি; যতটা চোখে পড়েছে পরীমনিকে ক্রমাগত হেনস্থা করা কিংবা আফগানিস্তান নিয়ে উল্লাসের ইস্যু। অথচ বরিশালকাণ্ডে যে বার্তা পাওয়া গেল, তা নিয়ে নানাপ্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, হচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে, শোকের মাসে শোক পালন ভুলে রাজনীতিক আর আমলারা যখন রণক্ষেত্র তৈরির আয়োজনে মেতে উঠেছিলেন, তাতে হতাশ না হয়ে পারে না কেউ।

আগেও বলেছি, রাজনীতি নিয়ে এখন খোলা মনে কিছু লেখা বা বলা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। যে কোনো কিছু লেখার মুহূর্তের মধ্যেই অতিশক্তিশালী মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করা হয়। তারপর সেই লেখককে সমালোচনার টেবিলে নিয়ে ইচ্ছেমত কাটাছেঁড়া করে রঙ লাগানো হয়। এই স্পর্শকাতরতা কিংবা ‘অতিরাজনীতিকরণ’ সমাজকে যে দিন দিন ভয়াবহভাবে অসহনীয় করে তুলছে তারই প্রমাণ বরিশাল। রাজনৈতিক সত্য প্রকাশের সুযোগ ব্যক্তি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে চরমভাবে সীমিত হয়ে পড়লে এমনটাই হতে বাধ্য। আর এই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির সংক্রমণে দিন দিন গণমাধ্যমের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছে। ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ আত্মঘাতী ঝুঁকি নিতে আর রাজি নন গণমাধ্যমকর্মীরা। সে কারণেই বরিশালকাণ্ডে নীবরতার পক্ষে তাদের অবস্থান।

বলা বাহুল্য, বেশিরভাগ গণমাধ্যমে কর্মী থেকে শুরু করে সংবাদ ব্যবস্থাপক কিংবা উদ্যোক্তারা পর্যন্ত এখন প্রবলভাবে রাজনীতিপ্রবণ। রাজনীতির সীমাহীন শক্তিকে ব্যবহার করার কৌশল হিসেবেই উদ্যোক্তারা গণমাধ্যম নামের ‘ডিভাইস’ স্থাপন করতে ‘অফেরতযোগ্য’ বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন। যে ‘ডিভাইস’ নগদ মুনাফা দিতে ব্যর্থ হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করে সব ময়লা-কলঙ্ক-আবর্জনা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিস্ময়কর সুযোগ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে আমজনতার শেষ ভরসা, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভখ্যাত গণমাধ্যমের ‘পাওয়ারহাউজ’ হিসেবে বিবেচিত ‘বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ’ বা খবরের’ ধার বা কার্যকারিতা কমে গিয়ে ভোঁতা ছুরিতে পরিণত হয়। যা অসুস্থ পথে হাঁটা রাজনীতিক কিংবা আমলাদের স্বাস্থ্যকর পথে ফেরাতে ব্যর্থ হয়।

অবশ্য যে আমলাদের আমরা রাষ্ট্রের ‘চাকরবাকর’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছি, তারা কিন্তু ভিনগ্রহের কেউ নন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে দেশের সবচেয়ে মেধাবী আর ফ্রন্টবেঞ্চাররাই আমলা হয়ে ওঠার সুযোগ পান। যারা আমাদেরই কারো ভাই-বোন-বন্ধু। আর বিশেষ ব্যতিক্রম বাদে প্রবল সাহসী অথচ অমেধাবী, ব্যাকবেঞ্চাররাই রাজনীতিক হয়ে ওঠেন সুযোগ খোঁজেন। তারাও আমাদেরই স্বজন-প্রিয়জন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমলারা সাধারণত উঠে আসেন আমজনতা থেকে দূরে থাকা পড়ার টেবিল থেকে আর রাজনীতিকরা রক্তাক্ত রাজপথ থেকে। চারিত্রিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যের কারণেই তাই দুই পক্ষের মধ্যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি হয়। তবে অসুস্থ রাজনীতির আঁচরে ক্ষতবিক্ষত আমলাদের অনেকে নিজেদের বৈশিষ্ট খুইয়ে ফেলেন।

বাকি থাকে মুনাফায় বিক্রি হওয়া গণমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে রাজনীতিক আর আমলাদের মিথষ্ক্রিয়ার ব্যাপারটি। মেধাবী আমলা আর অতিসাহসী রাজনীতিকদের গাইড করার জন্য যে ধরনের মেধা, বুদ্ধিমত্তা আর যোগ্যতার প্রয়োজন বেশিরভাগ গণমাধ্যম কর্মীর তাতে ব্যাপক ঘাটতি থাকে। যে ভাষা আর অঙ্গভঙ্গিতে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের সঙ্গে দ্রুত সংযোগ তৈরি করার কথা তা অর্জন করতে ব্যর্থ হন কোনো কোনো সংবাদকর্মী, বিশেষত যাদের অবস্থান প্রান্তিক পর্যায়ে। ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন নিয়ে জটিলতা তারই প্রমাণ। অন্যদিকে, রাজনীতিকদের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক গড়ে তাতে আর যাই হোক শক্তমনোবল ধরে রাখার সুযোগ প্রায়ই থাকে না। আমলা, রাজনীতিক আর গণমাধ্যমকর্মীদের ভারসাম্যহীন এই সম্পর্কের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকার আর শাসকদল। এই সত্য উপলব্ধি যত দ্রুত হয়, দেশ ও রাজনীতির জন্য ততই মঙ্গল।

লেখক: সাংবাদিক

10 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন