২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

আ’ লীগের হাসানাত আব্দুল্লাহ’র বিপরীতে কোন্দলে বিধ্বস্ত বিএনপি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:০০ পূর্বাহ্ণ, ২০ নভেম্বর ২০১৮

একদিকে দক্ষিণের ৬ জেলার প্রবেশদ্বার আর অন্যদিকে সংসদীয় এলাকার শুরু। এই দু’য়ে মিলে বরিশালের গৌরনদী উপজেলা। এর সঙ্গে আরেক উপজেলা আগৈলঝাড়া নিয়ে গঠিত হয়েছে বরিশাল-১ আসন। বিএনপি-আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি – এই ৩ দল থেকেই এখানে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হয়েছেন এমপি। তবে জয়ের পাল্লা বেশী ভারি ছিল আওয়ামী লীগের দিকেই। স্বাধীনতার পর এই আসনে প্রথম এমপি হন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত। পরে তাতে ভাগ বসান বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। অবশ্য সেসব নির্বাচনের সুষ্ঠু নিরপেক্ষতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

৯০’র গনঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর ’৯১ ও ’৯৬’এ দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী কাজী গোলাম মাহবুব ওরফে ছরু কাজীকে পরাজিত করে এমপি হন ১৫ আগস্টের শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমানে পূর্ন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় থাকা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনিই এখানে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নেতা। কেবল এই আসনই নয়, পুরো দক্ষিণেই তার ব্যাপক প্রভাব। তাকে বলা হয় দক্ষিনাঞ্চল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিভাবক। ফলে বরিশাল-১ আসনে হাসানাতেই ভরসা আওয়ামী লীগের। বলাবাহুল্য বিএনপির মূল লড়াইটাও হবে হাসানাতের সঙ্গেই। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় এমপি হন হাসানাত।

এর আগে ২০০৮ সালে হাসানাতের অনুপস্থিতিতে বিএনপি প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহানকে হারিয়ে এমপি হয়েছিলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে বরিশাল-২ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস। সেবার অবশ্য ইঞ্জিনিয়ার সোবাহানের পরাজয় প্রশ্নে কিছু জটিলতাও ছিল। দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনে নামার পর সোবাহানের মনোনয়নপত্র বাতিল করে রির্টানিং দপ্তর। সেই বাতিলের বিরুদ্ধে আদালতে যান তিনি। উচ্চ আদালত থেকে যখন তাকে নির্বাচন করার অনুমতি দেয়া হয় তখন ভোটের মাত্র ৭/৮ দিন বাকি। সেই স্বল্প সময়ের প্রচার-প্রচারনায় ৭৫ হাজারের মতো ভোট পান সোবাহান। এরকম পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে আগামী নির্বাচনের ফলাফল কোন দিকে যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে স্থানীয় বিএনপিতে বিরাজমান ত্রিধাবিভক্তি দূর না হলে জয়ের পাল্লাটা যাবে আওয়ামী লীগেরই দিকে।

এই আসনে বর্তমানে বিএনপির একাধিক প্রার্থী লড়ছেন মনোনয়নের জন্য। সম্ভাব্য এই তালিকায় রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দলীয় মনোনয়নে ২০০৮’এ নির্বাচন করা ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান, বিএনপির সাবেক এমপি ওয়ান ইলেভেনের সংস্কারপন্থী নেতা এম জহিরউদ্দিন স্বপন, কেন্দ্রীয় কমিটির বরিশাল বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল এবং বরিশাল জেলা উত্তর বিএনপির সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার ড. এম. শাহ আলম। এছাড়া জাতীয় পার্টির (এরশাদ) ঢাকা দক্ষিণ শাখার সদস্য অ্যাডভোকেট সেকেন্দার আলী, জাপার কেন্দ্রীয় সদস্য এসএম রহমান পারভেজ, গৌরনদী জাপার সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউনুস বেপারী, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপার প্রার্থী আগৈলঝাড়া উপজেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক সরদার হারুন রানা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র মুহাম্মদ রাসেল সরদার মেহেদী এবং গৌরনদী উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমীর হাফেজ মাওলানা মো. কামরুল ইসলামের নাম প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে। ৯১ সালে এমপি হলেও দল ক্ষমতায় না থাকায় উন্নয়ন প্রশ্নে খুব একটা ভুমিকা রাখতে না পারলেও ’৯৬ সালে আবার এমপি হওয়া এবং চীফ হুইপ’র দায়িত্ব পাওয়ার পর তার পুরোটাই পুষিয়ে দেন হাসানাত আবদুল্লাহ। দুই উপজেলায়ই ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড করেন তিনি।

এরপরও ২০০১’র নির্বাচনে তাকে পরাজিত করে এমপি হন বিএনপির প্রার্থী তৎকালীন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এম জহিরউদ্দিন স্বপন। কিন্তু ১/১১’র ধাক্কায় বিএনপি মূল ধারা থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। বর্তমানে গ্রামের বাড়ি সরিকল ছাড়া দুই উপজেলা সদরে বলতে গেলে ঢুকতেই পারেন না স্বপন। বর্তমানে যে ৫ জন বিএনপি নেতা এখানে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ইতিবাচক নয়। সবারই রয়েছে নিজস্ব বলয়। যার ফলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও বিভক্ত ৫ ভাগে। আর এই একটি কারনেই এখানে বিএনপি’র চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশী শক্তিশালী আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা হয় গৌরনদীর পৌর মেয়র মোঃ হারিস’র সাথে। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘এ আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, স্কুল-কলেজের ব্যাপক উন্নয়ন হয়। বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে মানুষ শান্তিতে বসবাস করছে। অপরদিকে বিএনপি বহু গ্রুপে বিভক্ত। এই আসনে হাসানাত ভাইয়ের জয় শতভাগ নিশ্চিত।’

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বিএনপির বিভক্তির সূচনা ২০০৯ সালের অক্টোবরে ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহানকে আহ্বায়ক করে ৪৬ সদস্যবিশিষ্ট গৌরনদী উপজেলা আহ্বায়ক কমিটি, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সদস্য মনিরুজ্জামান মনিরকে আহ্বায়ক করে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট গৌরনদী পৌর আহ্বায়ক কমিটি ও আবদুল লতিফ মোল্লাকে আহ্বায়ক করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট আগৈলঝাড়া উপজেলা আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এই তিন আহ্বায়ক কমিটিতে বরিশাল জেলা উত্তর বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম-আহ্বায়ক (বর্তমানে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক) আকন কুদ্দুসুর রহমানের হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন সমর্থক স্থান পায়। এছাড়া সাবেক এমপি জহিরউদ্দিন স্বপনের কোনো সমর্থককে তিন কমিটির কোথাও রাখা হয়নি।

তাৎক্ষনিকভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে উল্লেখিত ৩ কমিটি প্রত্যাখ্যান এবং পাল্টা কমিটি ঘোষণার পাশাপাশি কুদ্দুস সমর্থকরা গৌরনদী উপজেলা আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান ও পৌর আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা এবং কমিটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে। এরই মধ্যে আহ্বায়ক কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ রুপ পায় এবং এর পাশাপাশি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় নতুন কমিটি গঠনের কাজ শেষ করে। এসব কমিটিতেও রাখা হয়নি কুদ্দুস ও স্বপন সমর্থক কাউকে। এই অবস্থায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আবুল হোসেন মিয়াকে আহ্বায়ক করে গৌরনদী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি এবং একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর মনিরুজ্জামান মনিরকে সভাপতি ও শাহ আলম ফকিরকে সাধারণ সম্পাদক করে পৌর বিএনপির নয়া কমিটি করে আকন কুদ্দুসের সমর্থকরা। এ দুই কমিটি আবার মানে না ইঞ্জিনিয়ার সোবাহান ও তার সর্মথকরা। এখনও তাদের কমিটিই বহাল রয়েছে বলে দাবি তাদের। চলমান এসব বিরোধেই বছরের পর বছর ধরে পুড়ছে বিএনপি। এর সাথে যোগ হয়েছে নিরবে নিভৃতে থাকা সাবেক এমপি জহিরুদ্দিন স্বপন সমর্থক নেতা-কর্মীদের নেপথ্য বিরোধিতা।

আগামী নির্বাচনে এই আসনে দলীয় কোন্দলের প্রভাব কতটুকু পরবে জানতে চাইলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কথা স্বীকার করে আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘বৃহত্তর স্বার্থে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আমরা অবিচল ও ঐক্যবদ্ধ। মনোনয়ন নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে।’ দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেয়ায় মামলার আসামী হয়ে জেল খেটেছি। বিভিন্ন সময় এলাকায় দলীয় কর্মকান্ডে অংশ নিতে গিয়ে হামলা নির্যাতন হয়েছে আমার উপর।

২০০৮ সালে আমাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তারপরও মাত্র ৭/৮ দিনের প্রচার প্রচারনায় ৭৫ হাজার ভোট পেয়েছি। মনোনয়ন প্রশ্নে দল নিশ্চই এসব বিষয় বিবেচনা করবে। বিএনপি’র জন্য নিজের সর্বস্ব বাজি রেখে মাঠে ছিলাম এবং আছি। বাকি সিদ্ধান্ত এখন দলের।’

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন