২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

কেন পেশা ছাড়তে চান সাংবাদিকরা?

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৩৫ পূর্বাহ্ণ, ০৫ মার্চ ২০২১

নিয়ন মতিয়ুল >> যদি প্রশ্ন করা হয়, সংবাদমাধ্যমের কর্তারা তাদের কার্যালয়গুলোকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কতটা মানবিক করে গড়ে তুলেছেন? কিংবা আধুনিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তারা কতটা অনুসরণীয় কিংবা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন- যাতে রাষ্ট্রীয় থেকে শুরু করে বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তারা শিক্ষা নিতে পারেন? এ দুটি প্রশ্নের ‍উত্তর দিতে আরও কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করতে হবে।

প্রথমত, যারা জাতি বা রাষ্ট্র পরিচালনায় গাইড করেন কিংবা দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন- তারা সত্যিই কতটা অনুসরণীয়? দ্বিতীয়ত, এটা জানতে হবে, দেশের সংবাদমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে আধুনিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা? কিংবা আধুনিক বিশ্বের ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের সক্ষমতা শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের কতখানি? বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মূলভিত্তিগুলি সম্পর্কে তারা আদৌ কি কিছু জানেন বা জানার চেষ্টা করেন?

কিছু ব্যতিক্রম বাদে সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি, মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টার কিংবা সংবাদকর্মীরাই অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে একসময় সম্পাদক (সমপর্যায়ের) পদটি পেয়ে যান কিংবা লাভ করেন। অনিবার্যভাবে সংবাদসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতার পাল্লাই যাদের বেশি ভারী। সাধারণ ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কিংবা আধুনিক/বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগই হয়তো থাকে না তাদের।

অথচ সম্পাদকীয়/প্রধান নির্বাহী পদে এসেই তাকে ব্যবস্থাপনার মতো জটিল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সূক্ষ্ম কিছু বিষয়ে যুগোপযুগী দিক নির্দেশনাও দিতে হয়। এভাবে নানা ঘাতপ্রতিঘাত আর বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অদৃশ্যভাবে ব্যবস্থাপনায় পারঙ্গম হয়ে উঠতেই হয় তাকে। যদিও তার সে পারঙ্গমতার সঙ্গে আধুনিক ব্যবস্থাপনার কোনো মিলই থাকে না।

জাতিগত মনস্তত্বের বিষয়টি ভাবলে বলা যায়, শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে উপমহাদেশে চলা ঔপনিবেশিক আইন, শাসন আর প্রশাসনিক পদ্ধতি আমাদের মনস্তত্বে যে ছাপ ফেলেছে তা গেল ৫০ বছরেও ধুয়ে মুছে দিতে পারেনি আমাদের ‘পরশ পাথর’ রূপ রাজনীতি। মানসিকতার মধ্যে গেঁথে যাওয়া হীনমন্যতাবোধ সমাজের উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায়ে সদা জাগ্রত। আজও সমাজে শ্রেণিবিভেদ প্রকটরকম। আভিজাত্যবোধের ভয়ঙ্কর ছোবল কিংবা দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেননি বেশিরভাগই। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা কিংবা আইনের প্রয়োগে যার ছাপ প্রতিনিয়তই দেখতে পাই। বিশেষত, গণমাধ্যমের কর্তাদের মধ্যে হীনমন্যতা ভয়ঙ্কর রকম অধিক।

এমন বাস্তবতায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্ময়কর পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৃজনশীলতা আর কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে স্যোশাল মিডিয়ার বিপরীতে বিশ্বে মূলস্রোত হিসেবে টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের গণমাধ্যমের। আর এ টিকে থাকার লড়াইয়ে গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় ঢেলে না সাজালে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- কারা ঢেলে সাজাবেন? কারা কর্মীবান্ধব সৃজনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করবেন? তারা কি হীনমন্যতার শিকলে বাঁধা সেই কর্তারা; যারা একদা পাঠশালার পণ্ডিতদের চোখ রাঙানিতে আদর্শবাদী হয়ে উঠেছেন? নাকি সেই তারা- যারা রাজনীতির অতীত স্মৃতিতে বুঁদ হয়ে বদলে যাওয়া আধুনিক বিশ্বকে তুমুলভাবে উপেক্ষা করছেন? নাকি যারা অন্য পেশায় থাকতে না পেরে বেছে নিয়েছেন ‘দেশ উদ্ধারের’ মতো মহান কাজ। যেখানে হীনমন্যতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়?

বলা ভালো, করপোরেট বিশ্বের ধাক্কায় আধুনিক হয়ে ওঠা অনেক গণমাধ্যম কার্যালয়েই মানবসম্পদ নামে বিভাগ রাখা হয়েছে। যেসব বিভাগে দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা কাজও করছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মীনিয়োগ আর পদোন্নতির চিঠিপত্র চালাচালির মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ। আধুনিক ব্যবস্থাপনার অনিবার্য অনুসঙ্গ- উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ, ট্রেনিং, মোটিভেশন, জব এনালাইসিস, দক্ষতা মূল্যায়ন, জব স্যাটিসফ্যাকশন, কর্ম পরিবেশ নিশ্চিতকরণ- শব্দগুলোর সঙ্গে তারা কোনোভাবেই পরিচিত নন।

বেশিরভাগ গণমাধ্যমে যেসব ‘সংবাদ ব্যবস্থাপক’ নিয়োগ দেয়া হয় আধুনিক ব্যবস্থাপনার অনুসঙ্গগুলো বাস্তবায়ন সম্পর্কে কোনো ধারণাই যেমন তার থাকে না, তেমনি তাকে সে ধারণা দেয়াও হয় না। গণমাধ্যমে আধুনিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগে দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশের পাশাপাশি ‘নিউজ কোয়ালিটি’ যে বহুগুণ বাড়তে পারে, সে সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও থাকে না তাদের। বরং ব্যবস্থাপকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

প্রচলিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কিংবা উর্ধ্বতন কর্মকর্তার গতানুগতিক পথে পরিচালিত হয়ে সংবাদ ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ রকম সক্রিয় থাকেন তারা। যেখানে ‘তৈল মর্দন’ কিংবা ‘হুংকারবাদ’ ছাড়া আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োগে তাদের কোনো গরজ নেই। বরং দক্ষতা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি অপ্রয়োজনীয় ও নির্দয় পথ বেছে নেন। সংবাদকক্ষের কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি করেন। তাতে ভালো, সফল আর কঠোর প্রশাসক- এসব তকমা পেয়ে যান চোখের পলকে। যদিও সংবাদমাধ্যমের বিকাশ তথা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আর কোনো তাগিদই অবশিষ্ট থাকে না।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, দেশের বহুমুখী সংকট কিংবা স্বসৃষ্ট সব ভয়বহ সমস্যা সমাধানে গণমাধ্যমকর্মীদের যত উপায়ে, যত ধরনের দায়িত্ব পালন করা বিষয়ে গবেষণা করা হয়, নিজস্ব সমস্যা নিয়ে কি ততটা আলোচনা হয়? সভা, সেমিনার, বক্তৃতা, বিবৃতিতে কর্মীবান্ধব ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটা সেকেন্ডও কি ব্যয় করা হয়? যে মানসিক পীড়ন আর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সেই পদ্ধতিতে কি মানবিকতা থাকে? সাংবাদিক কর্তারা ঘন ঘন বিদেশে যান, সেখানে গিয়েও তো কর্মীবান্ধব ব্যবস্থাপনা আর মানবিকবোধ সম্পন্ন হওয়ার শিক্ষাটা নিয়ে আসতে পারেন?

বর্তমানে গণমাধ্যমে যে কর্মপরিবেশ আর প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের অপদস্থের শিকার হতে হচ্ছে তাতে বিষণ্ণতার চেয়েও তাদের জন্য বড় কোনো কিছু অপেক্ষা করছে। ইউল্যাবের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের জরিপ বলছে, দেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ সাংবাদিক তাদের পেশা নিয়ে বিষণ্ণতায় ভুগছেন। আর প্রায় ৭২ শতাংশ তাদের পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। এ সংবাদ যখন সাংবদিকদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছে তখন অন্যরকম মজাটা পাবেন। দেখবেন যারা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী তারাই ‘কণ্ঠ ছাড়বেন জোরে’। দোষ দেবেন মালিক পক্ষের, দোষ দেবেন সময়ের, অনেকেই আঙ্গুল তুলবেন সরকার কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে। নিজেদের পাশবিকতা কিংবা মূর্খতা বা মস্তিস্কবিকৃতির বিষয়টা বেমালুম ভুলে যাবেন।

তবে জরিপের ফলাফল সঠিক হয়নি বলেও অনেকে মন্তব্য করছেন। তারা দাবি করছেন, সংখ্যা আরো বেশি হবে। কেউ বলছেন, অন্তত ৯১ শতাংশ সাংবাদিক বিষণ্ণতায় ভুগছেন। আর পেশা ছাড়তে চান অন্তত ৯৫ শতাংশ। যদিও সংখ্যা দিয়ে মানুষের মর্যাদার বিচার করা যায় না। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার প্রয়োজন আগে। তবে আগামীতে সাংবাদিকতা পেশা মানেই যদি হয় হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের ছড়াছড়ি কিংবা সামাজিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত পেশা তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। (চলবে…)

(মিডিয়া ভাবনা: ৪ মার্চ, ২০২১। এলিফেন্ট রোড, ঢাকা।)

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন