৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

অবশেষে উজিরপুরের সেই বিতর্কিত ওসি শিশিরের বদলি, জনমনে স্বস্তি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০২:১৫ পূর্বাহ্ণ, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক:: বর্তমান সময়ে বরিশাল জেলা পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সবচেয়ে বিতর্কিত কর্মকর্তা ছিলেন উজিরপুর মডেল থানর ওসি শিশির কুমার পাল। তার বিরুদ্ধে থানায় বৃদ্ধাকে আটকে প্রহর ও সাংবাদিকদের দমন-পীড়নসহ কর্মক্ষেত্রে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগসমুহের বেশ কয়েকটি তদন্ত করছে বাংলাদেশ পুলিশের উচ্চমহল।

তদন্তাধীন অভিযোগগুলোর যদি একটিও প্রমানিত হয় তাহলে তার ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তিনি চাকরিচুত্যও হতে পারেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র। বিতর্কিত এই কর্মকর্তার অভিযোগগুলো তদন্তাধীন থাকা অবস্থায় তার বদলির আদেশ যেন উজিরপুর বাসীকে স্বস্তি দিয়েছে।

নিজের অপকর্মে দেশব্যাপী সমালোচিত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওসি শিশিরকে গত মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) রাতে বদলি করা হয়। একই সাথে উজিরপুর মডেল থানার নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে মোঃ জিয়াউল আহসান যোগদান করেন।

জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ওসি শিশিরকে একই রেঞ্জের বানারীপাড়া থানায় বদলি করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১লা মার্চ উজিরপুর মডেল থানায় যোগদান করেছিলো ওসি শিশির কুমার পাল। এরপর থেকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও একের পর এক আইন পরিপন্থী কাজ করে তিনি দেশব্যাপি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলো। তার বিভিন্ন অপকর্মে গোটা বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের ভাবমুর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।

এমনকি বিতর্কিত এই ওসি’র বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বানিজ্যের মাধ্যমে অবৈধ সম্পত্তি গড়ার অভিযোগ পৌঁছায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মহাপুলিশ পরিদর্শকের (আইজিপি) দপ্তরে। যে অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত ওসি শিশির উজিরপুর মডেল থানায় যোগদানের পর থেকেই উপজেলার আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছিলো। যার কারনে আতংকের মধ্যে থাকা উপজেলাবাসী নিজেদের জানমালের নিরাপত্তায় রাত জেগে পাহারাও দিয়েছিলো একাধারে কয়েকমাস। কিন্তু তবুও থেমে ছিলোনা চুরি-ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ মূলক কর্মকান্ড। যোগদানের পরপরই ওসি শিশিরের নির্দেশে মাদক মামলার আসামী ছেড়ে দেওয়ার চুক্তিতে ঘুষ নিতে গিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার হয়েছিলো।

এরপর ওসি শিশির উজিরপুরের চিহ্নিত মাদক বিক্রেতাদের সাথে গভীর ঐক্য করে তাদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেয়া শুরু করে। এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করলে ওই সকল সংবাদকর্মীদের ওপর চড়াও হয় ওসি শিশির। শুরু করে একের পর এক সাংবাদিককে দমন-পীড়নে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি। এক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করে স্থানীয় চিহ্নিত একদল সশস্ত্র চাঁদাবাজ গ্রুপকে ব্যবহার শুরু করে ওসি শিশির।

পুলিশের এই কর্মকর্তা উজিরপুর থানায় দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে বেশ কয়েকটি আলোচিত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছিলো। পাল্লা দিয়ে বেড়েছিলো ধর্ষন ও প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা। অহরহ হয়রানি হতে হয়েছিলো সাধারন মানুষকে। থানায় সার্বক্ষনিক ছিলো চিহ্নিত দালালদের দৌড়াত্ম। ওসির বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় নির্যাতন ও মামলা-হামলার শিকার হয়েছিলো উজিরপুরের বেশ কয়েকজন সাহসী সাংবাদিক।

এছাড়া উপজেলার আলোচিত জল্লা ইউপির জননন্দিত চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ হালদার নান্টুকে প্রকাশ্যে হত্যাকান্ডের ঘটনা প্রমাণ দিয়েছিলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে ওসি শিশিরের ব্যর্থতার। ওই হত্যাকান্ডের পরে জল্লায় স্থানীয়দের বসত বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ও নারকীয় তান্ডবের অভিযোগ উঠেছিলো।

চেয়ারম্যান নান্টু হত্যাকান্ডের পরেরদিন ওসি শিশিরের উপস্তিতিতে বাহেরঘাট এলাকায় দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে তান্ডব চালায়। আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলা হয়েছিলো প্রবাসীর খোকন সরদারের বহুতলা ভবন ও একই গ্রামের হালিম সিকদারের পুত্র সাইদুল সিকাদার দোকান ঘরটি। দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায় মালামাল। তখন ওসি শিশিরের ভ‚মিকা ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ।

সূত্র মতে, উজিরপুর মডেল যোগদানের আগে বরিশাল রেঞ্চ পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পুলিশে কর্মরত ছিলেন বিতর্কিত ওসি শিশির। সেখানেও বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিলো। এর আগে শিশির ওসি হিসেবে প্রথম পটুয়াখালি জেলার গলাপিচা থানায় দায়িত্ব পালন করেন। সেখানেও বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম,দুর্নীতি ও আইন পরিপন্থী কাজ করায় গলাচিপা থানা থেকে প্রত্যাহার হয়ে বরিশাল জেলায় আসেন। এরপর থেকে শাস্তিমূলকভাবে দীর্ঘদিন জেলা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত ছিলো ওসি শিশির।

বিতর্কিত এই ওসির বাড়ি ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। দুর্নীতিবাজ এ পুলিশ কর্মকর্তা উজিরপুর থেকে বদলির কয়েকমাস আগে নতুন একটি ট্রাক কিনে এই থানা এলাকায় ভাড়া দিয়েছিলেন। তার ক্রয়কৃত অশোক লেল্যান্ড কোম্পানির বরিশাল মেট্টো-ট-১১-০১২০ ওই ট্রাকটির দাম প্রায় ৭০ লাখ টাকা। ট্রাকটির লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রে তার স্ত্রীর নাম ব্যবহার করেছেন সুচতুর এই পুলিশ কর্মকর্তা।

এছাড়া ওসি শিশিরের নিজ এলাকায় তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে প্রায় ৮ থেকে ১০টি বাস গাড়ি রয়েছে। যা সেখানকার রুটে নিয়মিত চলাচল করে। এখানেই শেষ নয়।

ওসি শিশির উজিরপুর থানায় দায়িত্বে থাকা কালিন চলতি বছরের গত ২ সেপ্টেম্বর দিনে দুপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে এক উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তার মোটর সাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় তাৎক্ষনিক পুলিশকে খবর দিয়ে থানায় সাধারন ডায়েরি করা হলেও অদ্যবধি পর্যন্ত পুলিশ মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করতে পারেনি।

একই বছরের ৮ আগস্ট দিবাগত রাতে ওসির নির্দেশে জামিনে থাকা মামলায় উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের পূর্ব মুন্ডপাশা গ্রামের দিনমজুর সোহরাব হোসেন বেপারীর ছেলে হাসান বেপারিকে থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা আটক করে এবং পরে ছেড়ে দেওয়ার শর্তে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করেন। দাবীকৃত টাকা দিতে না পারায় রাতভর হাসানকে থানা হাজতে আটকে রেখে কোনো কারন ছাড়াই পরেরদিন ৯ আগস্ট সকালে আদালতে প্রেরণ করে। পরে কোর্ট জিআরও’র কাছে হাসানের জামিনের রি-কলের কাগজপত্র দেখালে হাসানকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এরআগে গত ২৩ জুলাই দিবাগত রাতে উপজেলা সদরের শিকারপুর মেজর এম এ জলিল সেতু সংলগ্ন দক্ষিন শিকারপুর গ্রামের পুলিশ সদস্য সালাম খানের বাসায় পরিবারের সবার হাঁত-মুখ বেঁধে মারধর করে দুর্র্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতিকালে ওই পুলিশ সদস্যের বাসায় থাকা স্ত্রী, ছেলে, বৃদ্ধা শ্বাশুড়ীসহ চার জনকে পিটিয়ে ডাকাতরা আহত করেছিলো।

গত ৩ জুলাই বিকেলে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উপজেলার মেজর এমএ জলিল সেতু সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ পরিচয়ে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এক সুপার এজেন্টকে অস্ত্র ঠেকিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় থানা পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করে আটক করতে পারেনি।

সর্বশেষ বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজির কাছে উজিরপুর ওসির বিরুদ্ধে নালিশের অপরাধে চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে থানার ভিতরে ও বাইরে রাশেদা বেগম নামে এক বিধবা বৃদ্ধাকে মারধরের অভিযোগে দেশব্যাপী সমালোচিত হয়েছিলেন ওসি শিশিরসহ এক পুলিশ সদস্য। ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছিলো।

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন