৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

ধুলায় ধূসর চলার পথ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:১৬ অপরাহ্ণ, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮

মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম নিঃশ্বাস থেকে শেষ নিঃশ্বাসের মাঝখানের সময়টুকুই জীবন। এর মানে নিঃশ্বাস আছে তো জীবন আছে, নিঃশ্বাস নেই তো জীবন নেই।

নিঃশ্বাসের সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কারণেই কবি কবিতায়, গীতিকার গানে বারবার প্রেমিক-প্রেমিকার উপমা টেনে এনেছেন। এমনকি সাধক স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের তুলনা দিতে প্রতিটি নিঃশ্বাসে তাকে স্মরণ করেন।

‘পানির অপর নাম জীবন’- এই কথা অস্বীকারের উপায় না থাকলেও পানি ছাড়া কয়েকদিন মানুষ বাঁচতে পারলেও নিঃশ্বাসের জন্য বায়ুহীন কয়েক মুহূর্ত বেঁচে থাকা অসম্ভব।

নিঃশ্বাসের জন্য শুধু বাতাস হলেই চলে না। বাতাসে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত দরকারি উপাদান থাকা আবশ্যক, যাকে আমরা বলি বিশুদ্ধ বাতাস।

যেমন হিমালয়ের চূড়ায় কিংবা দক্ষিণ মেরুতে বাতাস থাকলেও বিকল্প অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। বাতাসে যদি অতিরিক্ত ক্ষতিকর উপাদান থাকে তাহলে নিঃশ্বাস নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যু ঘটে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনাই সেটা প্রমাণ করে। যেমন পোশাক কারখানায় আগুন লাগলে সেখানে যত মানুষ পুড়ে মারা যায় তারচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় দূষিত ধোঁয়ার কারণে।

দূষিত বাতাসের সংজ্ঞা যে সবসময় এক হবে তা-ও কিন্তু ঠিক নয়। তবে এটা ঠিক যে স্থানভেদে আমরা কম-বেশি দূষিত বাতাস গ্রহণ করছি। এর ফলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু না ঘটলেও ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

রাজধানীবাসীর কথাই ধরা যাক। আমরা প্রতিনিয়ত নিঃশ্বাসের সঙ্গে সহনীয় মাত্রার বেশি দূষিত বাতাস গ্রহণ করছি। ফলে অ্যাজমা, ফুসফুসে ক্যান্সার, হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়াসহ জটিল ও কঠিন রোগ আমাদের মৃত্যু ত্বরান্বিত হচ্ছে।

আমরা যে বাতাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে বেঁচে আছি কিংবা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তার দূষণের মাত্রা সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নই। যারা সচেতন তারাও ঢাকা শহরের দূষিত বাতাস গ্রহণে করে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এছাড়া কি-ই-বা করার আছে আর!

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ইপি-এর ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে জানা যায়- ১৮০টি দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়।

এ সূচকটি বিশেষ করে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। অথচ মাত্র এক যুগ আগেও অর্থাৎ ২০০৬ সালে আমরা বায়ুদূষণের দিক থেকে ছিলাম ১২৫তম।

খোলা স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলা, শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, ঢাকা শহরকে ঘিরে সহস্রাধিক ইটের ভাটা, যথাযথ সুরক্ষা ছাড়া ইমারত নির্মাণ, জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত গাড়ির কালো ধোঁয়া, ঘনবসতি পাশাপাশি বৃক্ষ নিধন, জলাশয় ভরাটসহ বিভিন্ন কারণ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।

আরেকটি বিষয় দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বায়ুদূষণের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছে মেট্রোরেল, বিআরটি, এমআরটিয়ের মতো মেগা উন্নয়ন প্রকল্প।

ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের দূষিত বায়ুর পার্থক্য বুঝতে একজন সাধারণ মানুষই যথেষ্ট। যেমন দেশের দক্ষিণাঞ্চল কিংবা উত্তরাঞ্চলের তুলনামূলক নির্মল বায়ু গ্রহণকারী যখন ঢাকা শহরের বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশনে কিংবা লঞ্চঘাটে নামেন তখন তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারেন তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

আমাদের দেশে সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বায়ুদূষণ থাকে সর্বাধিক। বিশেষ করে ঢাকায় বায়ুদূষণের তীব্রতা দেখা যায় শীতকালে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় জানা যায়, শীতকালে ঢাকায় প্রতি ১০ জনে পাঁচজন মানুষের মৃত্যুর কারণ দূষিত বায়ু।

কী আছে ঢাকার বাতাসে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ঊচঅ) বায়ু মানের রিপোর্ট প্রকাশের জন্য বায়ুর মান সূচক প্রকাশ করে যা Air Quality Index সংক্ষেপে অছও হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। এ সূচকে বায়ুতে ওজোন গ্যাস, কণাযুক্ত বস্তু, কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এ পাঁচ ধরনের দূষণকে ভিত্তি করে দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ সূচকে ৫০-এর নিচে বাতাসের মান ভালো হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ৩০০ কে চিহ্নিত করা হয় বিপজ্জনক হিসেবে। ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি তারিখে এ সূচকে ঢাকার বায়ু ছিল ৫৫৬ যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত। ঢাকার বায়ুদূষণের তীব্রতা বোঝাতে এ সূচকই যথেষ্ট।

রাজধানীতে বায়ুদূষণের চেহারা যখন এই, তাহলে বাঁচার পথ কী অবশ্যই আছে। আমরা লড়াকু জাতি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের স্বল্পতা নিয়ে বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের ঢাকার মেগা প্রকল্পগুলো কাজ শেষ হলে অনেকটা পরিচ্ছন্ন রূপ ফিরে পাবে। সেইসঙ্গে কমে যাবে পুরনো মেয়াদবিহীন যানবাহনের সংখ্যা। পরিবেশবান্ধব ইটভাটার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

প্রকৃতি সংরক্ষণ করে নগরায়ণ করতে হবে। শিল্প, কল-কারখানাও গড়ে তুলতে হবে পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে। পরিচ্ছন্ন ঢাকার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রায়ত আনিসুল হক।

ইতিমধ্যে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া রাজধানীতে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকেরই কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। বায়ুদূষণ রুখতে প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্যই কাঙ্খিত ফল বয়ে আনতে পারে।

8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন