৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার

পৃথিবীর সবচে বেশি পঠিত মহাগ্রন্থ আল-কোরআন

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৫৯ অপরাহ্ণ, ০৬ অক্টোবর ২০২৩

মো. জিল্লুর রহমান>> পৃথিবীতে কোরআন একমাত্র ঐশী গ্রন্থ, যার ব্যাপারে আল্লাহ কোরআনের শুরুতেই মানুষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। কোরআন ছাড়া অদ্বিতীয় কোনো গ্রন্থের ব্যাপারে নির্ভুল বলে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়নি। আল্লাহ বলেন, ‘এটা সেই গ্রন্থ যাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুত্তাকিনদের জন্য এটা পথ নির্দেশ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২)। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন এবং এটি হচ্ছে এমন একটি ঐশী গ্রন্থ যার প্রথম নাজিলকৃত আয়াতের প্রথম শব্দ ইকরা বা পড়। অর্থ্যাৎ মহাগ্রন্থ আল কোরআনে পড়া বা জ্ঞানার্জনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বই শব্দটি এসেছে ওহি থেকে। ওহি থেকে বহি, তারপর বই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো আল-কোরআন। তার ভাষা, বর্ণ, বর্ণনা, সাহিত্য, উপমা, কাব্য ও গদ্যরীতি, রসবোধ পৃথিবীর সব গ্রন্থকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে গেছে। জগতের এ বইয়ের নির্মাতা স্বয়ং আল্লাহ এবং তা অবতীর্ণও হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উপর মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাযিল হয়েছিল, অথচ তিনি ছিলেন একজন নিরক্ষর আরব এবং এটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বড় মোজেজা। কারণ কোরআন যদি শুরুতেই কোন শিক্ষিত পন্ডিত ব্যক্তির উপর নাজিল হতো, তবে অনেকেই বলতো এটা তার নিজস্ব রচিত গ্রন্থ।

মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে পূর্ববর্তী উম্মত, তাদের শরিয়ত, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঘটনা এবং জীবন ধারণ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত সবকিছুই সত্য ও যথার্থ, যুক্তির বিচারে প্রমাণিত। ইতিহাসে আলোড়িত ও আলোচিত ঘটনা; কাহাফবাসী থেকে শুরু করে ইব্ররাহিম (আ.) এর কাবা নির্মাণ, মুসা (আ.) এর নীল নদ পাড়ি, তার জাতির মান্না সালওয়া খাবার, ঈসা (আ.) এর পবিত্র মাতার কাহিনী এবং এমন বহু ঘটনা কোরআনে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কোরআন একটি গতিশীল ও কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী মুজেজা বা অলৌকিকতায়। অন্যান্য সব নবী রাসুলগণের মুজেজা এবং তাদের ওপর নাযিলকৃত কিতাব বা গ্রন্থ তাদের জীবন পর্যন্ত কার্যকর ও বিদ্যমান ছিল। কিংবা অন্য নবী আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল। কিন্তু মহানবী (সা.) এর ওপর অবতীর্ণ মুজেজা কোরআনুল কারিম তার মৃত্যুর পরও পূর্বের ন্যায় আপন বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান রয়েছে।

কোরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি উপদেশ গ্রন্থ নাযিল করেছি এবং তা সংরক্ষণের দায়িত্ব আমার নিজের।’ (সুরা হিজর, আয়াত: ৩৭)। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মক্কা মদিনার কোলে মহানবীর ওপর কোরআন নাযিল হয়। কোরআন শুরুতে যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে, দেড় হাজার বছর পরও তাতে বিন্দুমাত্র রদবদল হয়নি। কোনো পবিবর্তন পরিবর্ধনের ছোঁয়া লাগেনি। পৃথিবীর অন্য গ্রন্থের ব্যাপারে এমন কল্পনাও করা যায় না। পৃথিবীর আর কোন গ্রন্থ কন্ঠস্থ করে মুখস্থ রাখার বিধান নেই, একমাত্র আল কোরআনই নাযিলের পর থেকে কন্ঠন্থ করে রেখে আসছে এবং এ ধারা কেয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এ কারণেই মানুষের অন্তরে মহাগ্রন্থ আল কোরআন নির্ভুলভাবে বেঁচে আছে। নির্ভুল এই কোরআন একটি ছোট বাচ্চার পবিত্র কলবেও নির্ভুলভাবেই বেঁচে থাকে।

কোরআনের বর্ণ, শব্দ, ভাষা, রচনা শৈলী, উপমাতে আজ অবধি কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়নি। কিয়ামত পর্যন্ত এটি টিকে থাকবে এবং মানুষকে কল্যাণের পথ দেখাবে। রাসুল (সা.) বলেন ‘আমি তোমাদের মধ্যে এমন দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি যা আঁকড়ে থাকলে তোমরা কোনোদিন পথভ্রষ্ট হবে না। আর তাহলো আল্লাহর কোরআন এবং তার নবীর সুন্নত।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক, হাদিস ১৫৯৪)

আল-কোরআন কাঠামোগতভাবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও এর বক্তব্য ও বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা সুগভীর। প্রতিটি শব্দ, বাক্য, বক্তব্য ও বিষয়বস্তু এতই ব্যাপক যে, এর শ্রেষ্ঠত্বের ভূয়সী প্রশংসায় বিশ্বের মনীষীগণ পঞ্চমুখ। সুদীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ সময়ের প্রয়োজনে খণ্ড-খণ্ড আকারে অবতীর্ণ এ গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য এতটাই তত্ত্ব ও তথ্যবহুল যে, অমুসলিম মনীষীরা বারংবার আল-কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। আর তাই তারা তাদের প্রয়োজনে বারংবার আল-কোরআনের দ্বারে ফিরে এসেছে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই তারা কোরআনের কাছে ফিরে এসেছে। কখনো সামাজিক বিষয়াবলী জানতে, কখনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান পেতে, কখনো আবার বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণে, কখনো গবেষণার তত্ব তালাশ করতে। তৎকালীন সাহিত্য-সমৃদ্ধ যুগকে যেমন তাক লাগিয়ে দিয়েছে এই কোরআনের প্রতিটি বাক্য তেমনই প্রতিটি যুগের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমান বিজ্ঞানের যুগকেও করেছে চমৎকৃত। আর তাই পরিপূর্ণ এই আসমানী গ্রন্থের আলোচনায় মুখরিত হয়েছেন অমুসলিম মনীষীগণ।

বিখ্যাত ফরাসি শল্যচিকিৎসাবিদ ড. মরিস বুখাইলি তার রচিত ” বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান” বইটির মুখপত্রে লিখেছেন, ‘অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোকে বাদ দিয়ে কোরআন বিজ্ঞানের যে ক্ষেত্রগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল তা আমাকে প্রথম দিকে গভীর বিস্ময়ে পূর্ণ করেছিল’। কোরআনে বর্ণিত বিজ্ঞান সম্পর্কিত আয়াতগুলো সম্পর্কে তিনি একই বইয়ে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘কোরআনে এমন একটি বক্তব্য নেই যা আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক বা সাংঘর্ষিক’। কোরআনের বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কোরআনকে বিজ্ঞানীদের জন্য বিজ্ঞানের একটি একাডেমী, অভিধানবেত্তাদের জন্য একটি অভিধান, ব্যাকরণবিদদের জন্য একটি ব্যাকরণের বই, কবিদের জন্য একটি ছন্দময় বই এবং আইনের এনসাইক্লোপিডিয়া হিসাবে গণ্য করা হবে’।

কোরআন ও কোরআনের নির্দেশনাবলি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। পৃথিবীতে এ যাবৎ যেসব বই এসেছে বা আসবে, এর প্রত্যেকটির সীমা নির্ধারিত। এছাড়াও আল্লাহর নবীদের ওপর যে গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছিল, সেগুলোও ছিল জাতি ও গোত্র বিশেষের জন্য সীমিত। একমাত্র মোহাম্মদ (সা.) এর ওপর অবতীর্ণ গ্রন্থ পুরো বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। পৃথিবীর সব মানুষের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে বিশেষায়িত হয়েছে।

মানব জীবনের সব বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। আল্লাহ বলেন ‘পরম করুণাময় তিনি, যিনি তার বান্দার প্রতি ফায়সালা গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হয়।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ০১)। কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে মানুষের অন্তর্নিহিত কিছু বিষয়ের সুসংবাদ দিয়েছে, পরে সংশ্লিষ্ট লোকদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে এসব কথা সত্য। তাদের মনে উদিত বিষয় এরকমই ছিল। এটা একমাত্র আল্লাহর কাজ। আর যে গ্রন্থে মনে উদিত কথার সংবাদ দেওয়া হয়েছে, সে গ্রন্থও স্বয়ং আল্লাহর।

ভবিষ্যতে ঘটবে এমন বহু ঘটনার সংবাদ কোরআন পূর্বেই দিয়েছে, যা পরে হুবহু সংঘটিত হয়েছে। কোরআন শরিফের সুরা আর রুমের এক থেকে চার নম্বর আয়াতে ঘোষিত হয়েছে ‘আলিফ, লাম, মিম। রোমকরা পরাজিত হবে। নিকটবর্তী এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর অতিসত্তর বিজয়ী হবে কয়েক বছরের মধ্যে। অগ্র-পশ্চাতের কাজ আল্লাহর হাতেই। সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে। আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।’ পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় রোম সাম্রাজ্যের জয়-পরাজয়ের কথা বিধৃত হয়েছে। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মক্কার কুরাইশরা আবু বকর (রা.) এর সঙ্গে এই আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা সম্পর্কে বাজি ধরেছিল। শেষ পর্যন্ত কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রোম বিজয় লাভ করে এবং আবু বকর (রা.) বাজিতে জিতেও বিনিময় নেয়নি।

কোরআন একমাত্র গ্রন্থ যা পাঠ করলে সওয়াব হয়। প্রতি হরফে হরফে পুণ্য হয়। পাঠকারীর ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। কোরআন শরিফ শ্রবণ করলে মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সবার ওপর প্রভাব পড়ে। সবার মনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কোরআন পাঠের মহিমায় মানবহৃদয় হারিয়ে যায় রবের করুণা বৈভবে। মন প্রশান্ত হয়ে অন্য রকম ভালো লাগা তৈরি করে। জুবাইর ইবনে মাতআম (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একদিন রাসুল (সা.) কে মাগরিবের নামাজে সুরা তুর পড়তে শুনেন। মহনবী (সা.) যখন শেষ আয়াতে পৌঁছলেন, তখন জুবাইর বলেন যে, ‘মনে হলো যেন আমার অন্তর উড়ে যাচ্ছে।’

কোরআন শরিফ বারবার পাঠ করলেও মনে বিরক্তি আসে না। যত বেশি শ্রবণ করা যায়, ততই ভালো লাগে। শুনতেই ইচ্ছে করে, মনে হয় যেন এই মাত্র শুনলাম। বরং আরও আগ্রহ বাড়তে থাকে। অধীর আগ্রহে দুনিয়ার কোনো খেয়াল থাকে না। কোরআন শ্রবণকারী যেন দুনিয়াবিচ্ছিন্ন মানুষ। এই গ্রন্থ পাঠ করলে অফুরান সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাদিসে বিধৃত হয়েছে ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব কোরআনের একটি হরফ পাঠ করবে, সে একটি নেকি পাবে। আর প্রতিটি নেকি লেখা হয় দশগুণ। আমি বলি না আলিফ-লাম-মিম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মিম একটি হরফ।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৯১০)।

পৃথিবীর একমাত্র অপরিবর্তিত ও অবিকৃত গ্রন্থ হল আল-কোরআন। মহাগ্রন্থ আর কোরআন নাযিলের দেড় হাজার বছর পরেও এর একটি অক্ষর, হরফ কিংবা সাকিনেরও কোন পরিবর্তন হয়নি। আজ পর্যন্ত কেউ কোরআনকে পরিবর্তন করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে সফল হতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। বিখ্যাত খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক বাডল বলেন, ‘কেবল কোরআনই এমন একটি গ্রন্থ, যাতে দেড় হাজার বছরের ব্যবধানেও কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের এমন কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ নেই, যা আদৌ কোন দিক থেকে কোরআনের সমকক্ষ হতে পারে’।

যেকোন বই সময়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দর্পণ। বইয়ের হরফ শুদ্ধ আলোর প্রদীপ। যে আলোয় উদ্ভাসিত হয় সমাজ ও সমাজের মানুষ। যে আলোয় সূর্যের মতো দেখা যাবে আগামী দিনের পথ। যে আলোয় নির্মাণ হবে আদর্শ, মানবতাধারী এবং ভালোবাসার মানুষ। তবে সে বই হতে হবে ওহি উৎসারিত এবং ওহির আলোয় জ্বলমলে। মহাগ্রন্থ আল কোরআন সে রকম একটি গ্রন্থ যা যুগে যুগে মানুষকে আলোকিত করেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত এ অমিয় ধারা অব্যাহত থাকবে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট ।

19 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন