২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বরিশালের ভাটিখানায় ভরাট হচ্ছে শতবর্ষী পুকুর, জনমনে ক্ষোভ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:৪৩ অপরাহ্ণ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

আহমেদ জালাল, বরিশাল:: বরিশাল নগরীতে একে একে ভরাট হয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পুকুরগুলো। ভূমিদস্যুদের থাবায় শত বছরের পুরনো অসংখ্য পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে নগরীর অসংখ্য পুকুরের নাম-নিশানা পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে-পুকুর এবং খালগুলোও ভরাটের ফলে পরিবেশ দূষণে মানবসভ্যতা বিরোধী প্রতিযোগিতা চলছে। ভরাট হওয়া পুকুর ও খালগুলোতে বহুতল ভবন এবং মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। আবার যেসব পুকুর রয়েছে সেসবও পর্যায়ক্রমে ভরাটের পায়তারায় মগ্ন রয়েছেন পরিবেশ বিনষ্টকারী ভূমিখেকোরা। বিশেষ করে বরিশাল নগরীর ভাটিখানা কাজীবাড়ি মসজিদ লাগোয়া আকতারুনেচ্ছা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের শতবর্ষী পুকুরটি ভরাটের সকল আয়োজন প্রস্তুতি সম্পন্নের নীলনকশায় পথে রয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাত থেকে পুকুর ভরাটের জন্য ট্রাকে ট্রাকে বালু ফেলা হচ্ছে।

এদিকে, শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে হঠাৎ করে পুকুর ভরাটের এহেন দৃশ্য দেখে এলাকাবাসী হতবাক হয়ে যান। নিরবে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এলাকার শান্তিপ্রিয় নারী পুরুষ। শতবর্ষী এই পুকুরটি ভরাটের দৃশ্য কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ এই পুকুরে এলাকার শত সহস্র লোকজনের পানি সমস্যা সমাধান করে আসছিল। তবুও এলাকার সাধারণ জনগণ ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। প্রতিবাদের ভাষা নেই। পুকুর ভরাটের এহেন নোংরামীতে বোবা কান্নায় ভাটিখানাসহ আশপাশ এলাকার বাসিন্দরা।  প্রশ্ন হচ্ছে- পুকুরটি কে ভরাট করছে? এমন প্রশ্নে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে- নগরীর আলেকান্দা এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ নামের এক ব্যক্তি পুকুরের মালিক। যেহেতু ফয়েজ গং মালিক সেহেতু তারাই ভরাট করছেন। কিভাবে ফয়েজ পুকুরের মালিক এমন প্রশ্নে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন-ফয়েজ গং ভাটিখানা আকতারুনেচ্ছা স্কুলের সম্পত্তি দান করেছেন। আর স্কুলের সামনের পুকুরটি স্কুল প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই তাদের ছিলো। সেই সূত্রে ফয়েজ গং পুকুর ভরাট করছেন।

অপর একটি সূত্র বলছে- ভাটিখানার কাজী বাড়ি মসজিদের মুয়াজ্জিন মাসুদ কাজী গং আকতারুন্নেচ্ছা স্কুলের সম্পত্তি দান করেছিলেন। যদিও কাজী গংদের স্কুলে সম্পত্তি দানের বিষয়ে কোন ধরণের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। নির্ভরযোগ্য স্থানীয় বয়স্ক একাধিক ব্যক্তির ভাষ্য- কাজী বাড়ি মসজিদের সামনের পুকুরটির মালিক নগরীর আলেকান্দা নুরিয়া স্কুলের লাগোয়া বাসিন্দা ফয়েজ মিয়া। ফয়েজ মিয়া মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী, এক ছেলে এবং চার মেয়ে উত্তারাধিকার সূত্রে পুকুরটির মালিক। প্রয়াত ফয়েজ মিয়ার পুত্র তারেক পুকুরের খোঁজ খবর রাখতেন। কয়েক বছর আগে তারেক মারা যান।

ভাটিখানার বাসিন্দা মনু মিয়া বলেন- তারেক আমাকে পুকুরটি দেখশুনা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পুকুর দেখভাল করে আসছিলাম। কিন্তু তারেক মারা যাওয়ার পর পুকুর দেখভাল এর দায়িত্বে আমি নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে- রাতের আধার থেকে বস্তায় বস্তায় পুকুরে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। আর স্থানীয় সাধারণ মানুষ হতবাক হয়ে শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখছেন। আর চোখের জল ফেলছেন কেউ কেউ।

সূত্র জানায়- স্থানীয় আজাহার মুনশীর মেয়ে মাসুমা আক্তার পুকুরটির কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি বলেন-যাদের মালিকাধীন পুকুর তারাই ভরাট করছেন। কেয়ারটেকার মাসুমা আরও বলেন-ফয়েজ গং পুকুরের মালিক। ফয়েজ মিয়ার ছেলে তারেক মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী রেখা তারেক বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে নিজে দাড়িয়ে থেকে পুকুর ভরাটের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পুকুর ভরাট প্রসঙ্গে ফয়েজ গংদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতি’র (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিঙ্কন বায়েন বলেন- পরিবেশ আইন অনুযায়ী জলাশয়, পুকুর ভরাট সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। আর নগরীর ভাটিখানা কাজী বাড়ি মসজিদের সামনের পুকুরটি শতবর্ষী পুকুর হিসেবে চিহ্নিত। সুতরাং এই শতবর্ষী পুকুর ভরাটের সঙ্গে যারাই যুক্ত থাকুক, তারা বেআইনীভাবে কাজ করছেন। এ বিষয়টির খবর পেয়ে ইতিমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরে অবহিত করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন বলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতি’র (বেলা)বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিঙ্কন বায়েন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সমাজকর্মী রাজনীতিক অ্যাডভোকেট একে আজাদ বলেন-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই পুকুরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই পুকুরটি যদি ভরাট হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ওই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের স্বাস্থ্যহীনতা চরম ঝুঁকির মধ্যে দেখা দিতে পারে। এই কারণে সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অনুরোধ অবিলম্বে পুকুর ভরাট বন্ধ করা হোক।

ভাটিখানা শতবর্ষী পুকুর ভরাট প্রসঙ্গে বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো: আবদুল হালিম বলেন- পুকুর ভরাট কোনভাবেই করা যাবে না। এটা আইনগতভাবে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পুকুর ভরাটের ফলে পরিবেশের চরম বিপর্যয় ঘটিয়ে মানুষের চরম ভোগান্তির শিকার করা কারও কোন অধিকার নেই। এটা বেআইনীভাবে করা হচ্ছে। আর ভাটিখানা কাজীবাড়ি মসজিদের সামনে শতবর্ষী পুকুর ভরাট কে বা কারা করছে, কেন করছে এসব বিষয় খতিয়ে দেখে আইনগতপন্থায় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা এক আদেশে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জনগণের আশ্রয়স্থল রক্ষা ও অগ্নিনির্বাপণে সহায়তা করতে কোনো অবস্থায় খাল-বিল, পুকুর-নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করা যাবে না এবং এর গতিপথ পরিবর্তন করা যাবে না। তবে কোনো দপ্তর যদি সরকারি কাজে নিজস্ব পুকুর ভরাট করতে চায়, সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পুকুর ভরাটের একটি প্রস্তাব পাঠাতে হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৬ (ঙ) অনুযায়ী, জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ভরাট না করার বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাধার বা পুকুর ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনের ৭ ধারায় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র নষ্ট করে পরিবেশগত ক্ষতি ও বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে। জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। ওই আইনের ৫ ধারামতে, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।’

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন