২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

বরিশালের সন্তান সুফিয়া কামালের আজ মৃত্যুবার্ষিকী

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:৫৯ অপরাহ্ণ, ২০ নভেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সুফিয়া কামাল। আজ এই মহীয়সী নারীর ১০৮তম জন্মদিন। সাহিত্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুলের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে উজ্জীবিত ও তাঁদের প্রশংসায় ধন্য হয়ে, নারী মুক্তি আন্দোলনে বেগম রোকেয়ার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতার গৌরব নিয়ে এবং দেশবাসীর মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেছেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় :
মা সাবেরা খাতুন আর বাবা সৈয়দ আবদুল বারীর পরিবারে ১০ই আষাঢ় ১৩১৮, ২০শে জুন ১৯১১ সোমবার বেলা ৩টায় শিশু সুফিয়ার জন্ম। নানার দেয়া নাম সুফিয়া খাতুন। সুফিয়া বড় হয়েছেন তার নানার বাড়িতে ফলে তার শৈশব স্মৃতি পুরোটাই মাতৃকেন্দ্রিক।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা :
সুফিয়ার শৈশব কেটেছে নবাবী ঐশ্বর্যের মাঝে। শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। অন্দর মহলে মেয়েদের আরবি-ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলার কোনো স্থান সেখানে ছিল না। শিশু সুফিয়া বাংলা শেখেন তার মায়ের কাছে। তার বড় মামার বিরাট লাইব্রেরীটি সর্বভারতে প্রসিদ্ধ ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির আওতায় শিশু সুফিয়া চুরি করে বই পড়তেন এবং বাংলা শেখার চেষ্টা করতেন।
সে সময় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার গুলোতে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার কোনো রীতি ছিল না। কিন্তু ব্যতিক্রম শিশু সুফিয়া বায়না ধরলো যে স্কুলে যাবেই। অগত্যা শিশুর ইচ্ছা পূরণের জন্যে পায়জামা আচকান পরিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে রীতিমত ছেলে সাজিয়ে অভিভাবকরা স্কুলে পাঠালেন সুফিয়াকে।
মাত্র ৭ বছর বয়সে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতেই বেগম রোকেয়া সুফিয়াকে তার স্কুলে ভর্তি করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব সমস্যার কারণে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের একেবারে প্রথম যুগের ছাত্রী হবার দুর্লভ সুযোগ হাতের মুঠোয় এসেও পিছলে গিয়েছিল। অনেকের ধারণা, পরিবারের রক্ষণশীলতার কারণেই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে তার ভর্তির সুযোগ হয়নি।
সংসার জীবন :
মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাত ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে হয়েছিল। সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন প্রগতিবাদী ও নারী শিক্ষার সমর্থক। স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় বালিকাবধূ সুফিয়ার লেখার গতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। নেহাল হোসেনের ঐকান্তিক সহযোগিতায় সুফিয়ার লেখা পত্রিকায় প্রকাশের সুযোগ ঘটে, যা নববধূ সুফিয়ার জন্যে ছিল সত্যিই অকল্পনীয়। সুফিয়ার পরম সৌভাগ্য, এই বিবাহই তার সুপ্ত-প্রায় প্রতিভাকে সযত্নে লালন করে বিকাশের ধারায় প্রবাহিত করেছিল। শুধু তাই নয়, সুফিয়ার লেখা প্রকাশের দায়িত্ব নেয়ায় সৈয়দ নেহাল হোসেনকে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রচুর গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। সময়ের বিচারে নেহাল হোসেনের এই পদক্ষেপ সত্যিই যুগান্তকারী ছিল।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে নিদারুণ বিষাদের ছায়া। স্বামী নেহাল হোসেন আক্রান্ত হলেন দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে। স্বামীর সেবা শুশ্রূষায় সুফিয়া রাতদিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। বোম্বে, মাদ্রাজ, নৈনিতাল ঘুরে ফিরে হাওয়া পরিবর্তন করেও রোগ উপশমের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। শেষে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চলে এলেন শায়েস্তাবাদের বাড়িতে। শত চেষ্টায়ও নেহাল হোসেনের জীবন রক্ষা করা গেলো না।
মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ১৯শে ডিসেম্বর ৬ বছরের একমাত্র কন্যাসন্তান (আমেনা খাতুন দুলু) রেখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগ। এই সময়ে সবকিছু বিবেচনা করে সুফিয়া নিজেই উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেন। মূলত এখান থেকেই তার ব্যক্তিজীবন ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে দুর্যোগ মুহূর্তে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সূত্রপাত। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় উপার্জনের উপায়ের প্রশ্নে।
কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট তার ছিল না। এ রকম দুর্যোগময় দিনে তাকে দারুণভাবে সহায়তা করেন কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন এডুকেশন অফিসার শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজ উদ্যোগে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে সুফিয়াকে শিক্ষকতার চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। পঞ্চাশ টাকা মাইনের এই শিক্ষকতার চাকরি তখন সুফিয়ার জন্যে ছিল পরম পাওয়া। তিন মাসের মধ্যে সুফিয়া নিজ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষয়িত্রী পদে স্থায়ীভাবে বহাল হন।
এ সময় কর্পোরেশনের শিক্ষকদের মধ্যে তিনি পান কবি আব্দুল কাদির, কবি খান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি সাহিত্যিককে। পুরা ত্রিশের দশকটা ছিল সুফিয়ার জীবনে রীতিমত দুঃস্বপ্নের মতো। এ দুঃসময়ে অভয়, আশ্রয় ও সমবেদনার বাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন এক জ্ঞাতি-ভগ্নি বেগম মরিয়ম মনসুর। সে সময়ে বেগম মনসুর না থাকলে আজকের সুফিয়ার জীবন-ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।
সমস্ত দুঃখ, দারিদ্র্য ও মানসিক অশান্তির মধ্যে দেশের সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের সান্ত্বনা ও উৎসাহ তাকে নতুন প্রেরণায় নতুনভাবে বাঁচতে শেখায়। তাদের মধ্যে সাদত আলি আখন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম, মাহবুব-উল-আলম ও আবুল ফজল অন্যতম। সাদত আলি আখন্দই সর্বপ্রথম সুফিয়াকে কবি হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন।

১৯৩৯ সালের ৮ই এপ্রিলে চট্টগ্রামের কামালউদ্দিন খানের সাথে তার পুনঃবিবাহ হয়। বিবাহের পর তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হলেন। উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন কামালউদ্দিন খান ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি। তিনি কবির কাব্য-প্রতিভার সম্মান করতেন।
সুফিয়া কামালের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল সাধারণভাবে সকলের অগোচরে, অনেকাংশে নেপথ্যে। সাহিত্যরসিক কামালউদ্দিন খান ছাত্রজীবনে কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। বিয়ের পর তিনি সুফিয়ার কাব্য প্রতিভা বিকাশের প্রতিই বেশি যত্নবান ছিলেন। তিনি কবির লেখা সংরক্ষণ, পান্ডুলিপি তৈরি ইত্যাদি সযত্নে করতেন।
এ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ছেলে শাহেদ কামাল (শামীম), আহমদ কামাল (শোয়েব), সাজেদ কামাল (শাব্বীর) এবং মেয়ে সুলতানা কামাল (লুলু) ও সাঈদা কামাল (টুলু)। শোয়েব ১৯৬৩ সালে ১৩ মে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ৩রা অক্টোবরে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সুফিয়া কামালের দ্বিতীয় স্বামী কামালউদ্দীন খান মারা যান।
সাহিত্য কর্ম :
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘হেনা’ সুফিয়ার মনে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে। গদ্য লেখার নেশা পেয়ে বসে তাকে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে কবিতার প্রতি মোহগ্রস্ত হন তিনি। বেগম রোকেয়া, বেগম সারা তাইফুর ও বেগম মোতাহেরা বানু প্রমুখের লেখাও তাঁকে উত্‍সাহিত করে। বিয়ের সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন স্কুলের ছাত্র। বিয়ের পর বরিশাল বি.এম.কলেজ থেকে এন্ট্রাস ও এফ.এ. পাশ করে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেন্ট জেভিয়ার্স এ পড়ার সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন সস্ত্রীক কলকাতার তালতলায় এক বাসায় থাকতেন।
কলকাতায় অবস্থান করার সুযোগে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্‍চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লীলা রায়, শামসুন নাহার মাহমুদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত্‍ লাভের অভূতপূর্ব সুযোগ তিনি লাভ করেন। যা তাঁকে সাহিত্য চর্চায় আরো অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয়, স্বামীর উৎসাহ উদ্দীপনা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় সুফিয়া বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লাগলেন; এমনকি কংগ্রেস সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন।
 প্রথম লেখা প্রকাশ :
১৯২৩ সনে বিয়ের পর সুফিয়া ও নেহাল হোসেন বরিশাল শহরে চলে আসেন। বরিশালে সে সময় খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের পর এ.কে. ফজলুল হক ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজারা আন্দোলনে মেতে উঠেছে। শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বরিশাল তখন অনেক অগ্রসর। এ সময় বরিশাল থেকে বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সাপ্তাহিক ‘তরুণ’।
মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্র সরল কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তরুণ’ পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন সে সময়ের তরুণ মেধাবী ছাত্র সৈয়দ নেহাল হোসেন। ‘তরুণ’ পত্রিকার জন্যে লেখা চাই। নেহাল হোসেনের মনে হলো তার নববধু সুফিয়ার কাঁচা হাতের কিছু লেখা আছে। তিনি সুফিয়ার ২/৩ টি লেখা সম্পাদকের কাছে নিয়ে গেলেন। সম্পাদক একটি গল্প ও একটি কবিতা মনোনীত করে প্রথমে গল্পটি ছাপার ব্যবস্থা করলেন।
‘তরুণ’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় মিসেস এস.এন. হোসেন নামে সুফিয়ার প্রথম লেখা ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশিত হয়। আশ্চর্য ব্যাপার প্রথম লেখা প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দু মুসলমান সকলে অত্যন্ত প্রশংসা করে আরও লেখার জন্য তাঁকে উৎসাহিত করেন। এ সময় বাংলার শ্রেষ্ঠ মহিলা গীতিকবি কামিনী রায় আসেন বরিশালে। একজন মুসলমান মেয়ে গল্প ও কবিতা লিখছেন এ কথা শুনে তিনি নিজে সুফিয়ার বাসায় গিয়ে তাকে উৎসাহিত করেন।
সুফিয়ার ছোট মামা ফজলে রাব্বী সাহেব কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করে ভাগিনী সুফিয়ার কবিতা লেখার কথা কবিকে অবহিত করেন এবং কিছু কবিতা তাঁকে পড়তে দেন। তার কবিতা পড়ে নজরুল অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে ঢাকার ‘অভিযান’ পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা ছাপার ব্যবস্থা করেন। তখন ‘অভিযান’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ কাসেম। এভাবে কবিতার সূত্র ধরেই নজরুলের সাথে সুফিয়ার প্রথম পরিচয়।
নজরুল কলকাতায় ফিরে গিয়ে ‘সওগাত’ পত্রিকায় লেখা পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে বরিশালে সুফিয়াকে চিঠি লেখেন। একই সাথে তার ‘অঘ্রানের সওগাত’ কবিতাটি উপহার পাঠান। আনন্দ চিত্তে কবির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুফিয়া ‘সওগাত’ – এ লেখা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ‘সওগাত’ – সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সুফিয়ার কাঁচা হাতের শিরোনাম বিহীন লেখাগুলো পান্ডুলিপি উদ্ধারের মতো যত্ন সহকারে পড়ে নিজের থেকে শিরোনাম দিয়ে ‘সওগাত’ – এ তা প্রকাশের ব্যবস্থা করতেন। এ সময় থেকেই কবি-সাহিত্যিক মহলে সুফিয়ার পরিচয়ের সূত্রপাত।
‘সওগাত’-এ প্রথম লেখা :
১৩৩৩ সালে (১৯২৭ খ্রী:) সুফিয়া এন. হোসেন ‘সওগাত’-এ তার প্রথম কবিতা পাঠান। ফাল্গুন মাসে তার কবিতা ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের হাতে এসে পৌঁছে। পরের সংখ্যা অর্থাত্‍ চৈত্র সংখ্যায় তিনি তা ছাপার ব্যবস্থা করেন। তখনও নাসিরউদ্দীন সাহেব জানতেন না কে এই সুফিয়া এন. হোসেন, কোথায় তার বাড়ি? তবে একজন মুসলমান মহিলা কবিতা লিখছেন এটিই ছিল তার কাছে বড় কথা। নাসিরউদ্দীন সাহেব পরম যত্ন ও আন্তরিকতার সাথে ছাপার উপযোগী করে কবিতাটি (চৈত্র, ১৩৩৩) প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। চৈত্র সংখ্যায় কবিতা ছাপার পর এর পরের মাসেই আর একটি কবিতা ‘সওগাত’ অফিসে এসে পৌঁছে। এই কবিতার অবস্থাও তথৈবচ। নাসিরউদ্দীন সাহেব পূর্ববত্‍ প্রয়োজনীয় ঘষা-মাজা করে ‘বাসনা’ নাম দিয়ে ১৩৩৪ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় তা প্রকাশ করেন। বলতে গেলে এর পর সুফিয়া ‘সওগাত’ এর প্রায় নিয়মিত লেখিকায় পরিণত হন।
রবীন্দ্র-নজরুলের সান্নিধ্য :
কাজী নজরুল ইসলাম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ‘সাঁঝের মায়া’র ভূমিকা লিখে সুফিয়ার সাহিত্যিক মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শরত্‍চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গায়ক কে. মল্লিক, হরেন ঘোষ প্রমুখের সাথে সুফিয়ার পরিচয় করিয়ে দেন। নজরুলের যে কোনো বই প্রকাশ হলেই তিনি সুফিয়াকে এক কপি উপহার পাঠাতেন। সাথে লিখতেন কবিতার কয়েকটি লাইন বা কোনো মন্তব্য। এই উপহারগুলো অমূল্য সম্পদ হিসাবে ছিল সুফিয়ার কাছে।

একই সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা ও আশীর্বাদ বাংলা সাহিত্যে তাকে একটি স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, যখন সুফিয়ার বয়স মাত্র ১৭-১৮। প্রথম পরিচয়ের পর কবির জন্মদিনে তিনি কবিতা লিখে পাঠালেন। কবিও তাকে কবিতায় উত্তর দিলেন। তারপর তাদের সাক্ষাৎ এবং চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের পর ১৯৪১ সালে কলকাতার নাগরিক শোকসভায় সুফিয়া কামালকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
সমাজসেবা :
যখন সুকুমার দত্তের স্ত্রী সাবিত্রী দেবী কলকাতা থেকে বরিশালে এসে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অসহায় মা ও শিশুদের কল্যাণে ‘শিশুসদন ও মাতৃমঙ্গল’ গঠন করলেন, তখন এই সংগঠনের মাধ্যমে সুফিয়ার সমাজসেবায় হাতেখড়ি হয়। মাত্র চার বছর বেগম রোকেয়ার সংস্পর্শে থাকলেও সুফিয়া কামালের মানস-গঠনে, বিশেষ করে নারী মুক্তি আন্দোলনে, সর্বোপরি অনগ্রসর মহিলাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্যে কাজ করার যে শিক্ষা বেগম রোকেয়া থেকে তিনি পেয়েছিলেন, পরবর্তী জীবনে তার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখা যায়৷
১৯৪৬-এ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সুফিয়া কামাল দাঙ্গা দমনের কর্মকাণ্ড এবং সেবাকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। নিজ কন্যা আমেনা খাতুন ও বেগম মরিয়ম মনসুরের কন্যা জাকিয়া মনসুরকে নিয়ে কলকাতা ব্রেবোর্ন কলেজ সেন্টারে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করেন। তার ভাই হাসান জান ও অন্যান্য মুকুলফৌজ কর্মীদের নিয়ে সুফিয়া কামাল কংগ্রেস একজিবিশন পার্কের মধ্যেই ‘রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুল’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির স্কুল চালু করেন।
দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল চলে আসেন ঢাকায়। প্রখ্যাত নারীনেত্রী লীলা রায়ের অনুরোধে তিনি ‘শান্তিকমিটি’-র কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং সভানেত্রী মনোনীত হন। ১৯৪৮-এর আগস্টে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলার প্রগতিশীল মহিলা নেত্রী ও কর্মীদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’। ১৯৫১ সালের শেষ দিকে সমাজ-সচেতন মহিলাদের এক সমাবেশে গঠিত হয় ‘ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতি’, সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল।
১৯৬১ সালে সামরিক শাসন, সরকারি ভয়ভীতি, নিষিদ্ধ রাজনীতির থমথমে পরিবেশে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। একই সালে ‘ছায়ানট’-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী ‘মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১’-র বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালালে ১৯৬৩ সালে শামসুন্নাহার মাহমুদ ও সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী মুক্তি আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠন এর প্রতিবাদ করে।
১৯৬৫ সালে তিনি ‘নারীকল্যাণ সংস্থা’ এবং ‘পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এ আইয়ুব বিরোধী মহিলাদের সমাবেশে সভানেত্রীত্ব ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তার কর্মকান্ড গণঅভ্যুথানের আন্দোলনরত সংগ্রামী ছাত্র সমাজকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
১৯৭০ সালে গঠিত হয় ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’, যার সভানেত্রী হন তিনি। যুদ্ধ শেষে নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসনের কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। সেসময় ‘নারী পুনর্বাসন সংস্থা’-র সভানেত্রী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর তিনি ‘মহিলা পরিষদ’-র মাধ্যমে নারী সমাজের সার্বিক মুক্তির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড তাকে আবার প্রতিবাদী করে তোলে। সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে সব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আশি বছর বয়সে কার্ফূর মধ্যে মৌন মিছিলে নেতৃত্বদান ছিল তার সংগ্রামী জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা সে সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংগ্রামরত দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছিল৷
শিশু আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তার ছিল বিরাট অবদান। অবিভক্ত বাংলার শিশু সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’-এর আদলে ১৯৫৬ সালের ৫ অক্টোবর তার বাসভবনে গঠিত হয়েছিল প্রগতিশীল শিশু সংগঠন ‘কচি কাঁচার মেলা’, যার উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। অন্য শিশু সংগঠন ‘চাঁদের হাট’-এর সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন।
মৃত্যু :
১৯৯৯ সালে ২০ নভেম্বর শনিবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে এই অনন্য নারী মৃত্যুবরণ করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২৮ নভেম্বর তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
19 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন