২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

বরিশালে ভয়ঙ্কর কিশোর সন্ত্রাসী, ১৯ বাহিনীর উত্থান

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:২৬ অপরাহ্ণ, ১৪ অক্টোবর ২০১৯

বরিশালে ভয়ঙ্কর কিশোর সন্ত্রাসী, ১৯ বাহিনীর উত্থান

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: বরিশালে রাজনৈতিক উপ্তাপ নেই। আছে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ভীতিকর অস্থিরতা। এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা উঠতি বয়সী কিশোরদের সমন্বয় এসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে সমীহ করে চলতে হচ্ছে সাধারণ মানুষসহ ব্যবসায়ীদের। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা এই কিশোর সন্ত্রাসীরা হাল সময় এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। অস্থির পরিস্থিতিতে র‌্যাব-পুলিশ এখন যৌথ কায়দায় তাদের তালিকা প্রস্তুত করে গ্রেপ্তার অভিযানের পরিকলল্পনা নিয়েছে। কিন্তু এই অভিযান কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে প্রশাসনের মধেই কমবেশি কানাঘুষা চলার খবর পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি কিশোর সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া আচারণে রক্তপাতের এই ঘটনাকে কেন্দ্র তাদের দমনে কোতয়ালি পুলিশ মাঠে নামলেও সেই অভিযান দীর্ঘায়িত করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃবৃন্দের সুপারিশে পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সময়ের আলোচিত ‘আব্বা গ্রুপ’সহ অপরাপর বাহিনীর ২০ সদস্যকে। আটকদের আদালতে সোপর্দ করতে ব্যর্থতার কথা পুলিশ অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কোনমতেই তাদের আশ্রয়দানের বিষয়টি উচ্চরণ করতে নারাজ।

একাধিক সূত্র অভিন্ন ভাষায় বলছে- বরিশালে এলাকাভিত্তিক অন্তত ১৯টি কিশোর গ্যাং’য়ের তালিকা রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। নানা সময় নানান ঘটনার মধ্যদিয়ে উঠতি বয়সের এই সন্ত্রাসীরা আলোচনায় আসলেও এবারই প্রথম পুলিশ প্রশাসনকে ভাবনায় ফেলেছে। বিশেষ করে ‘আব্বা ও রিফাত’ এই দুটি গ্রুপ নিয়ে পুলিশ যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। একজন ছাত্রলীগ কর্মীকে কুপিয়ে চাঁদমারী এলাকা অস্থির করে তোলা রিফাত ও সদর রোডমুখী গড়ে ওঠা ‘আব্বা বাহিনী’ প্রধান সৌরভ বালা জনৈক এক অধ্যক্ষকে পিটিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এই জাতীয় একটি সহযোগী দৈনিকে তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক তরুণ এক সাংবাদিককে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পরে বরিশালে কিশোর সন্ত্রাসীদের উত্থান নিয়ে বিভিন্ন মহলে হৈচৈ পড়ে যায়।

সূত্র জানায়- নগরীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বিপর্যয় পরিস্থিতি উত্তরণে র‌্যাব ও পুলিশ কিশোর সন্ত্রাসীদের দমনে তোড়জোড় শুরু করে। প্রাথমিকভাবে র‌্যাব একটি তালিকাও প্রস্তুত করে। অনুরুপ পুলিশও কিশোর গ্যাংয়ের এলাকাভিত্তিক দৌরাত্ম্যের তথ্য-উপাত্ত¡ সংগ্রহ করে। সেই সাথে স্থানীয় মিডিয়া সোচ্ছার হলে উঠে আসে ১৯ কিশোর গ্যাংয়ের ভীতিকর অস্থিত্ব। বিষয়টি প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান প্রতিটি এলাকায় কমিউনিটি পুলিশের সভা ডেকে কিশোর সন্ত্রাসী প্রতিহতে স্থানীয়দের সহায়তা কামনা করেন। পাশাপাশি শুরু হয় নগরীর ৪ থানা পুলিশের সাড়াশি অভিযান। পুলিশের এই তৎপরতায় র‌্যাবও সংশ্লিষ্ট হচ্ছে এই খবরে নগরীতে সবে স্বস্তি ভাব লক্ষ্য হচ্ছিল। একই দিনের অভিযানে বিশেষ করে ভয়াঙ্কর সন্ত্রাসী ‘রিফাত ও আব্বা গ্রুপের’ ২০ কিশোরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বাগে আনতে সক্ষম হলেও বেশিক্ষণ থানায় রাখতে পাারেনি।

পুলিশের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশে অস্বকৃতি জানিয়ে বলে- সাঁড়াশি অভিযানে দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের একাধিক সদস্যকে আটকের পর তাদের ছেড়ে দিতে রাজনৈতিক সুপারিশে পুলিশকে বিধিব্যস্ত করে তোলা হয়। ফলে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা এবং তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎসমূল কোথায় তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের প্রস্তুতিময় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়- এইসব সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রস্তুতের পাশাপাশি তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতাদের নাম পরিচয় তারা জানতে পেরেছে।

এক্ষেত্রে উঠে এসেছে- ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড ভিত্তিক মূল দলের নেতাসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও যুবলীগ নেতার নাম। আলোচনায় থাকা সদর রোডমুখী ‘আব্বা গ্রুপ’র উত্থান এবং আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ নেতা আতিকুল্লাহ মুনিমের নাম শোনা গেছে। ছাত্রলীগের এই নেতা বসতবাড়ি নগরীর বিএম কলেজ সম্মুখে হলেও তিনি নগরীর প্রাণকেন্দ্রের ‘আব্বা গ্রু’র ভাল-মন্দ দেখাশোনা করেন। কী কারণে তিনি এই গ্রুপের আর্শিবাদদাতা হলেন তা নিয়েও নানা গল্প শোনা যায়। যদিও আতিকুল্লাহ মুনিম অস্বীকার করে বলেন- কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে তার কোন সখ্যতা নেই। অথচ নগরীর সিটি কলেজের অধ্যক্ষকের ওপর সকালে আব্বা গ্রুপের হামলা এবং বিকেলে আলোড়িত সিটি কর্পোরেশনের বাজেট ঘোষণা অধিবেশনে মুনিমের মিছিলে ‘আব্ব গ্রুপ’ প্রধান সৌরভ বালাসহ তার সেনা সদস্যদের অগ্রভাগে দেখা যায়। এই গ্রুপটি আগরপুর রোডসহ গোটা সদর রোডে আধিপত্য বিস্তার করেছে।

নগরীর আরেক ভীতিকর সন্ত্রাসী রিফাত বাহিনী জিলা স্কুল মোড় থেকে চাঁদমারী এলাকা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও এই রিফাতের শহরের ভিন্নপ্রাপ্ত বটতলা মুনসুর কোয়াটার এলাকায়।

বিভিন্ন সূত্রের অভিন্ন মত হচ্ছে- এই কিশোর গ্যাংটি বেড়ে উঠতে সহায়তা করছেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। অপর ১৭টি গ্রুপ স্থানীয় ছাত্র ও যুবলীগের নেতারা আশ্রয় দিলেও তারা প্রকাশ্যে ভুমিকা রাখছে না বলে শোনা যায়। কিন্তু ওইসব আশ্রয়দাতাদের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কমবেশি নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে বিসিক শিল্প এলাকায় একজন ছাত্রলীগ নেতার প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় বিস্তার করেছে ‘কশাই বাহিনী’র ডালপালা। এই বাহিনী প্রধান বর্তমান মামুনের নাম এখন বেশি প্রচারিত হলেও মূলত সম্পদ নামক এক তরুণই হচ্ছে এ গ্রুপের মূল কান্ডারি। সম্পদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিশ্চিত হওয়া গেছে। এক সময়ে বিএনপি ঘরনার ক্যাডার বিসিকের পুলিশ কামালের পুত্রই হচ্ছে সম্পদ। গত বিএনপির শাসনামলে পুলিশ কামাল আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন। এরপরেই পুত্র সম্পদ বেসামাল হয়ে ওঠে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দ্বিতীয় ধাপে সম্পদ রাজনৈতিক কারণে নিজেকে পিছনে রেখে কশাই মামুনকে সামনে নিয়ে আসে। কশাই মামুনের সাথে মহানগর ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী একজন নেতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ্য সখ্যতার কথা এলাকায় পা ফেললেই শোনা যায়। সাম্প্রতিকালে একজন ঠিকাদারকে আহত করার মধ্যদিয়ে কশাই বাহিনী প্রধান হিসেবে মামুন আলোচনায় আসে।

আর একটি ভয়াত্মক কিশোর গ্যাংয়ের পদচারণা কথা শোনা যায় বিএম কলেজ এলাকায়। বৌদ্যপাড়া মোড় থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত প্রায় মহড়া দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা এই গ্রুপটির নাম হচ্ছে ‘হাতুড়ি গ্রুপ’। বাহিনী প্রধান আজমল হোসেন রুমেল একাই রয়েছে নেতৃত্বে অগ্রভাগে। ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসী গ্রুপ অন্তত ৬০ জন কিশোরের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বলে তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে।

সাগরদী এলাকায় দাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ‘ইকরাম ও আরজু বাহিনী’। দুই কিশোরের নিয়ন্ত্রণাধীন এই বাহিনী কখনও কখনও নগরীর পশ্চিম জনপদ সিঅ্যাবি রোডেও মহড়া দেয় বলে শোনা যায়। এই বাহিনী পৃষ্ঠপোশাক কে তা নিয়ে ধু¤্রজাল রয়েছে।

তবে অনুসন্ধ্যানে নিশ্চিত হওয়া গেছে- স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের জনৈক এক নেতার মিছিলে তাদের দেখা গেলেও বিএনপি ঘরনার এক নেতাই এদের নিয়ন্ত্রক। ক্ষমতাসীন দলের নেকনজরে থাকার সুবিধার্থে কৌশলে পথচলা এই ধরনের আরও একটি গ্রুপ হচ্ছে কালিবাড়ি রোডের ‘হিরণ বাহিনী’। অন্তত ১৫ কিশোরের এই বাহিনী প্রধান হিরণ আদতে কোন রাজনীতি ঘরনার তা কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। কিন্তু বর্তমান সময়ে ছাত্রলীগ নেতা উজ্জল তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে স্থানীয়দের মুখে অভিযোগ শোনা যায়। সংশ্লিষ্ট এলাকায় সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ’র আবাসস্থল হলেও এই কিশোর সন্ত্রাসী গ্রুপের কাউকে তার বাসভবনে যাতায়াত করতে দেখা যায় না। কিভাবে উজ্জল তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন বা উদ্দেশ কী তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

নগরীর এক বিএনপির নেতার বিরুদ্ধেও কিশোর গ্যাং পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। কেডিসি এলাকার সাবেক কাউন্সিলর এই বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদিন নিজের অস্থিত্ব রক্ষায় দুরত্ব বজায় রেখে গড়ে তুলেছে ‘হৃদয়-আসিফ বাহিনী’। দুই কিশোরের সমন্বয়ে দুর্ধর্ষ উত্থান এই গ্রুপে জয়নাল আবেদিনের পুত্র সন্তান এনাউল হাওলাদার অন্যতম সদস্য বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সম্প্রতি পুলিশের হাতে গাঁজা সমেত এনাউল আটক হয়। বর্তমানে এই কিশোর কারান্তরীণ রয়েছে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকার নদীকূলবর্তী এলাকা চরমোনাইতেও ভয়ঙ্কর কিশোর সন্ত্রাসীদের দৌঁড়ঝাপে নানা কাহিনী জানা গেছে। মীরা তারেকের নামে সেখানে গড়ে উঠেছে এই বাহিনী। মূলত বরিশালে কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে উল্লেখিতরাই বেশিমাত্রায় বেপরোয়া। রাজনৈতিক আশ্রয় থাকলেও মূলত এরা রাজনীতির বদলে রমিও স্টাইলে বিচারণ করতে বেশি অভ্যস্ত। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব মোটরসাইকেল। নতুবা অপর কারও মোটরসাইকেল সংগ্রহ করে সকাল বিকেল হর্ন বাজিয়ে এলাকায় মহড়া দেওয়াই হচ্ছে এদের ভীতি ছড়ানোর ধরন। নেশায় আসক্ত এই কিশোরদের বিরুদ্ধে রয়েছে এলাকাভিত্তিক মাদক নিয়ন্ত্রণ বা বাণিজ্যের অভিযোগ। আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে এদের আশ্রয়দাতারা ব্যবহার করায় পুলিশ আটক অভিযানে নামলেই তদ্বির শুরু হয়ে যায়। ফলে নিরাপদে এইসব কিশোর সন্ত্রাসীরা এখন রীতিমত সন্ত্রাস শুরু করায় আলোচনায় চলে এসেছে। ভাবিয়ে তুলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বরিশালটাইমসকে জানান, ইতিমধ্যে পুলিশ কিশোর সন্ত্রাসীদের দমনে মাঠে নেমেছে। ছাত্রলীগ কর্মীকে কোপানোর ঘটনায় রিফাত বাহিনীর ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করেন। রাজনৈতিক তদ্বিরে জোরেশোরে নামা পুলিশি অভিযান মুখ থুবরে পড়ছে কী এমন প্রশ্ন অবান্তর বলে তিনি মন্তব্য করে আগামীদিন পর্যালোচনার জন্য অপেক্ষা করতে বলেন।

বরিশাল র‌্যাবের উপ-অধিনায়ক মেজর সজিবুল ইসলাম বরিশালটাইমসকে জানান, নগরীর কিশোর গ্যাং দমনে তারা ইতিবাচক পদক্ষেপ রাখতে চান। সেই লক্ষে সুচারুভাবে এদের নাম পরিচয় এবং আশ্রয় প্রশ্রয়দাতাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে স্পষ্ট করেন।’

8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন