২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

ভারতে গ্রেপ্তার পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা বরখাস্ত

Saidul Islam

প্রকাশিত: ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

ভারতে গ্রেপ্তার পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা বরখাস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল >> প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ১১শ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত বহুল আলোচিত ই-অরেঞ্জের (ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান) অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও নেপথ্যের পরিচালক পুলিশ কর্মকর্তা শেখ সোহেল রানার জ্ঞাতআয়বহির্ভূত বিস্তর সম্পদের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। বিপুল সেই সম্পদের একটি অংশ ই-অরেঞ্জে বিনিয়োগ করেছিলেন বনানী থানার সাবেক এই পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত)। মূলত ই-অরেঞ্জ প্রতারণা করে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসার পরপরই আলোচনায় আসেন সোহেল রানা। এর আগে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ই-অরেঞ্জের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। কিন্তু মামলায় সোহেল রানার নাম ছিল না।

প্রতারণার এসব ঘটনায় গুলশান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় পৃথক দুটি মামলায় সোহেলের বোন মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর গ্রেপ্তার হলেও ওই পুলিশ পরিদর্শক অধরাই ছিলেন। মামলাতে তার নাম না থাকায় তিনি এতদিন সবকিছু অস্বীকার করে আসছিলেন। কিন্তু গত মাসের শেষ ভাগে ভুক্তভোগী ১৬ গ্রাহকের পক্ষে রাসেল নামে এক যুবক ই-অরেঞ্জের অন্যতম কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় ১০ নম্বর আসামি সোহেল রানা। মামলায় ৮৮ লাখ ৯৪ হাজার ৯১৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে

গুলশান থানাকে নথিভুক্ত করে তদন্তের নির্দেশ দেন। গুলশান থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয় গত ২ সেপ্টেম্বর। এই তথ্য জানার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে দেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন সোহেল।

ভারত হয়ে নেপালে পালিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে গত শুক্রবার বাংলাদেশ-ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত এলাকা থেকে সোহেলকে গ্রেপ্তার করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের নর্থ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ৩ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টায় স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার হওয়ার কথা স্বীকার করেন। আটকের সময় তার কাছে বিদেশি পাসপোর্ট, কয়েকটি দেশের মুদ্রা, থাইল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের কয়েকটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া যায়। ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় তাকে তিন দিনের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে কোচবিহার আদালত।

পুলিশের এই পরিদর্শক কীভাবে দেশ থেকে পালালেন, কোথায় যেতে চেয়েছিলেন?- এসব প্রশ্নের উত্তর তার মুখ থেকেই জানতে পেরেছে ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। তার স্বীকারোক্তিমূলক কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ এখন ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

বিএসএফের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল জানান, গত বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের পাটগ্রামে বাবু নামে এক দালালকে ১০ হাজার টাকা দিলে সোহেলকে তিনি ভারত সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দেন। এর পর একজন ভারতীয় তাকে টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট ছাড়াই ভারতে আশ্রয় দেন। সোহেলের লক্ষ্য ছিল শিলিগুড়িতে যাওয়া। সেখানে কপিল নামে এক বন্ধুর মাধ্যমে নেপালে যাওয়ার কথা ছিল তার। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে নেপাল থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানোর ছক কষছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

এদিকে বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে ফেরানোর পথ খুঁজছে পুলিশ। গতকাল রবিবার পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের কাছে পৃথক বক্তব্যে বিষয়টি খোলাসা করেছেন।

অন্যদিকে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানাকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে ধরা পড়া পুলিশ কর্মকর্তা শেখ সোহেল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সন্ধ্যায় সোহেল রানার সাময়িক বরখাস্তের আদেশ হয় বলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সোহেল রানার গ্রেপ্তারে খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া ছাড়াও নিজ কর্মস্থলে অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিতির কারণে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া রানার বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলাও হয়েছে, যা তদন্ত করা হবে বলে জানান আসাদুজ্জামান।

এর আগে রবিবার বিকালে পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, আপনারা বুঝতে পারছেন যে, পরিদর্শক সোহেল রানা নিয়মিত পথে যাওয়ার চেষ্টা করেননি, অনিয়মিতভাবে চেষ্টা করেছেন। তার দেশত্যাগে কারও গাফিলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সোহেল রানা কীভাবে দেশত্যাগ করল, তার দেশত্যাগে কারও গাফিলতি ছিল কিনাÑ সেসব বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্দি বিনিময় চুক্তি থাকায় তাকে ফিরিয়ে আনা সমস্যা হবে না।

পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কেউ কোনো অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আইজিপি বলেন, অপহরণ, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়া সদস্যদের বিষয়ে চাইলে আমরা এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তু আমরা এর মধ্যে নেই। আমরা ঘায়ে ব্যান্ডেজ না করে একেবারে ‘ক্লিন’ করছি। অভিযোগের প্রমাণ মিললে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা দিচ্ছি।

বোট ক্লাবের সভাপতিত্ব নিয়ে আইজিপিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি তো পার্লামেন্ট মেম্বার না, পার্লামেন্টের আলোচনা নিয়ে কি আমার কথা বলা ঠিক হবে? যেগুলো পার্লামেন্টে আলোচনা হয়, সেগুলো পার্লামেন্টের ভেতরেই থাকে। আপনার ব্যক্তিগত কৌতূহল থাকলে ব্যক্তিগত কৌতূহল মেটানোর জন্য আমরা ব্যবস্থা নেব। কিন্তু পার্লামেন্টের সংসদ সদস্য যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পাল্টা উত্তর আইজিপি দেবে না এই কারণে, পার্লামেন্টের কোনো কথার বিষয়ে বক্তব্য বাইরে দেওয়া যায় না।

এর আগে (রবিবার দুপুরে) নিজ কার্যালয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানান, ভারতে গ্রেপ্তার পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানাকে দেশে ফিরেয়ে আনা হবে। এ জন্য চেষ্টা চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিএসএফকে চিঠি দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যদি এ মাধ্যমে সম্ভব না হয়, তা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাকে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।

ডিএমপি কমিশনার আরও জানান, পরিদর্শক সোহেল রানার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতে পৃথক মামলা হওয়ায় তাকে বনানী থানা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার স্থলে নতুন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। ই-অরেঞ্জের হিসাব থেকে সোহেল টাকা তুলেছে- এটা জানা গেছে। তার সব অভিযোগের তদন্ত চলছে। পুলিশ রিপোর্ট হাতে পেলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানা গেছে, ই-অরেঞ্জের মাধ্যমে প্রতারণা করে গ্রাহকের কোটি কোটি আত্মসাতের আগেও বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সোহেল রানা। এভাবে তিনি কয়েক বছরের মধ্যে অস্বাভাবিক টাকার মালিক হন। জ্ঞাতআয়বহির্ভূত এই টাকার একটি অংশ ই-অরেঞ্জে বিনিয়োগ করা ছাড়াও বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান এই পুলিশ পরিদর্শক।

সোহেল রানার বিরুদ্ধে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তেই রাজধানীর অভিজাত এলাকা নিকেতনের ২টিসহ ৪টি ফ্ল্যাট; টিঅ্যান্ডজি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানÑ যার একটি শাখা গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে ও অন্যটি উত্তরার গরীব-ই-নেওয়াজ অ্যাভিনিউয়ে; গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে বিস্তুর কৃষিজমি; পূর্বাচলে তিন নম্বর সেক্টরে একটি প্লট, কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন একটি আবাসিক এলাকার ইএবংআই ব্লকে দুটি প্লট; রিসোর্ট তৈরির জন্য খাগড়াছড়িতে কয়েক একর জমি; বহুজাতিক কোম্পানির ডিলারশিপ; অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদসহ শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে।

গত কয়েক মাসে সোহেল রানা ই-অরেঞ্জ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তার অরেঞ্জ বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান। ই-অরেঞ্জের হিসাব থেকে সোহেল রানা প্রায় আড়াই কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন তার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা। বেশকিছু ব্যবসায়িক খাতে অরেঞ্জ বাংলাদেশের বিনিয়োগ রয়েছে।

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন