৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার

মৃত কিন্তু স্মরণীয়, সেই ‘আরজ আলী’র বঞ্চনার গল্প

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:১৫ অপরাহ্ণ, ০৮ আগস্ট ২০২৩

মৃত কিন্তু স্মরণীয়, সেই ‘আরজ আলী’র বঞ্চনার গল্প

শাকিব বিপ্লব, বরিশাল:: স্বাধীন ভূ-খণ্ড বাংলাদেশের স্বীকৃতির ৫২ বছর কেটে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রশিক্ষক শহীদ আরজ আলীর অবদানের স্বীকৃতি মেলেনি আজও। গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর এলাকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাসঙ্গিক বিষয় অবতারণা করলেই শোনা যায় আরজ আলীর সংগ্রামী গল্প এবং জীবন বিসর্জনের কাহিনী। বহু চেষ্টা করেও তার পরিবার মুক্তিযোদ্ধে অনন্য অবদান রাখা সত্বেও স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, মিলছেনা কারও সায়। বিপরিতে গৌরনদীতে ৪০০ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সময়ের ব্যবধানে দীর্ঘ হয়ে এখন প্রায় ২ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। অবিশ^াস্য ঘটনা- এই তালিকায় এমন ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে যিনি কিনা দেশ স্বাধীনতার প্রাক্কালে বয়স ছিলো ৪ বছর, অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কোন দ্বৈবশক্তির বলে স্বীকৃতির খেতাবও ঘরে টাঙিয়ে রেখেছেন, সুবিধা নিচ্ছেন সরকারি বিভিন্ন ভাতাসহ আমন্ত্রিত হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে। আরজ আলী সেক্ষেত্রে এতটাই উপেক্ষিত যে, তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। একপর্যায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও তার নামের সামনে শহীদ শব্দটিও ব্যবহার করতে যেন কুণ্ঠাবোধ করেন সহকর্মী যোদ্ধারা।

অবশ্য তারা স্বীকার করছেন আরজ আলীর গল্প সত্য- তিনি ছিলেন দুঃসাহসী এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধদের একজন। তাহলে গেজেটে কেন তার নাম নেই? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না বাটাজোর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল কাদের। তিনি স্বীকার করেন আরজ আলী পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুর সাথে সাথে তাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন গল্পেরও যেন সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ভোলেননি। তার অবদান স্মরণ করে হাজারখানেক টাকা পরিবারের উদ্দেশে পাঠিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির ত্রাণ তহবিল থেকে এই অর্থ দেওয়া হয়। ২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মাধ্যমে অনুদানের একটি চেকও পাঠিয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আরজ আলীর অবদান সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় শীর্ষ কর্ণধাররাও ওয়াকিবহাল।

তাহলে তার অবদানের স্বীকৃতি মুক্তিযোদ্ধার সনদ এবং নাম সরকারি তালিকাভুক্ত করতে স্থানীয়ভাবে অন্তরায় কোথায়? বয়াতি বংশের সন্তান আরজ আলী সম্পর্কিত এ তথ্য পাওয়ার পর বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলাপচারিতার যে তথ্য মিললো তার সার কথা হচ্ছে, এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে কেউ কোনো আবেদন করেননি। অথচ আরজ আলীর ৪ ছেলে ২ মেয়ে সকলের অভিন্ন দাবি, তার মা জীবদ্দশায় রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন দরজায় স্বামীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কাগজপত্রাদি নিয়ে দিনের পর দিন ঘুরলেও কেউ তা আমলে নেয়নি। এমনকি তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এমন অনেকেই রয়েছেন যারা এখন গৌরনদী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বে থেকেও এই শহীদ সহযোদ্ধার পরিবারের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়ায়নি। হাত বাড়াতে হবে কেন ? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিতকরণে কয়েক দফার উদ্যোগ ও তালিকা প্রণয়নকালে ঘুরে ফিরে আরজ আলীর নাম আসলেও এমন কোন ব্যক্তি স্বপ্রণোদিত হয়ে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করতে সদিচ্ছা দেখায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃবৃন্দ যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরী করেছে তার বিরোধিতা না করে বরং আরও উৎসাহিত করে সহকর্মীরাই তাদের নিকটজনদের মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পাইয়ে দিতে তোষামদিতে ব্যস্ত ছিলেন।

এমন ক্ষোভ জানিয়ে আরজ আলীর মেঝ ছেলে পেশায় দিনমজুর নজরুল ইসলাম জানান, অর্থের জোগান না দিতে পারায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি- তার বাবার নাম তালিকাভুক্ত করা। বিশেষ করে তার মা লালমোহন নেছা ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করলে আরজ আলীর মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদানের স্বীকৃতি আদায়ে পারিবারিক দৌড়ঝাপ বন্ধ হয়ে যায়। আরজ আলী যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং তাকে দেশ থেকে ফিরে যেয়ে পুনরায় বাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেয়া সত্বেও তিনি তা অগ্রাহ্য করেন, যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। কিছু কাগজ-পত্র এবং বঙ্গবন্ধুর এবং তার কন্যার অনুদানের চেকের প্রমাণ-পত্রাদি প্রয়াত মা অর্থাৎ আরজ আলীর স্ত্রী’র কাছে সংরক্ষিত ছিলো। যা পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। একেতো সন্তানেরা অতটা শিক্ষিত নয়, তার ওপর আর্থিক দুর্বলতায় সামাজিকভাবেও দুর্বল চিত্তের হওয়ায় বাবার সেই বীরত্ব গাঁথা মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে বাড়াবাড়িতে যেতে সাহস নেয়নি। আবার কখনও অগ্রসর হলেও থামিয়ে দেওয়া হয়েছে নানান ছল ছুতায়।

সম্প্রতি তার সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধা সনদের গুরুত্ব অনুধাবনে এনে বাবার সেই কাগজপত্র উদ্ধারে সচেষ্ট হলে চাচার ঘরে থাকা ফাইলপত্র ঘেটে কয়েকটি কাগজ উদ্ধার করলে পুনরায় আলোচনায় আসে আরজ আলীর সংগ্রাম এবং নিহত হবার দুঃসাহসিক কাহিনীনির্ভর ১৯৭১ এর সময়কাল নিয়ে কথা। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে সেনাসদস্য হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং যুবকদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে ‘মাস্টার দ্যা’ খ্যাতি নিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্মুখ সারিতে থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সর্বশেষ বাটাজোর এলাকায় হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের যৌথ আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করা আরজ আলীর গল্প নতুন করে শোনা যাচ্ছে যদি কিনা প্রাসঙ্গিক এই বিষয় নিয়ে কোন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলোচনার টেবিলে বসা যায়। বেশ কয়েক জন শীর্ষ সারির মুক্তিযোদ্ধা একই সুরে এই কাহিনীর বর্ণনা দিলেও কি কারণে তিনি এখনও যুদ্ধাহত হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন না তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে দিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। বাটাজোর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল কাদের অকপটে স্বীকার করলেন আরজ আলীর অবদান ভোলার নয়। পক্ষান্তরে প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো এতো কিছু জানা সত্বেও কেন তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামটি অন্তর্ভুক্ত করতে পদক্ষেপ নিলেন না কেন? প্রতিত্তোরে বললেন, তিনি নাকি জানতেন আরজ আলীর নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলেনি, তার পরিবার পাচ্ছেনা রাষ্ট্রীয় কোন ভাতা- এ খবর তার অজানা।

অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নে কয়েক দফা উদ্যোগ এবং নামের যাচাই-বাছাই প্রাক্কালে অনেকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কারা এবং কিভাবে তারা স্বীকৃতির আড়ালে রয়েছেন সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেননি তার বক্তব্যে তা প্রকাশ পায়। সেখানকার একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, রাজনৈতিক কারনে অনেক অনিয়োম দেখেও চুপ থাকতে তারা বাধ্য হয়েছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও অনেকেই এখন বীর মুক্তিযোদ্ধা (!) তাদের দাবি, গৌরনদী উপজেলায় ৪ শতাধিক তরুণ-যুবক ও মধ্য বয়সি ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। এখন ৪০০ নয়, ২ হাজারের কাছাকাছি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম রয়েছে। শুধু যে আরজ আলীর নাম নেই তা নয়, আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে তাদেরও নাম তালিকায় নেই। সুতরাং গৌরনদী উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরিতে অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি কম-বেশি অনেকেই অবগত।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, মুজিব বাহিনীর কমান্ডর হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোনের ছেলে বর্তমানে সাংসদ ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের কান্ডারী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ্ বাটাজোরের আরজ আলীর ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এমন দাবি করে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, তিনি আরজ আলী সম্পর্কে নীরব থাকায় কেউ এ প্রসঙ্গে উচ্চবাচ্য কারার সাহস নেয়নি। বরং অসহায় চিত্তে দেখতে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও অনেকে দলীয় প্রভাবে এখন দাপটশীল বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেই তালিকায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ৩ বছর বয়সি এক কিশোর কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলেন, যার নাম আবুল হোসেন। থাকেন উপজেলার টরকি এলাকায়। পেশায় দলীল লেখক এই ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়া নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা হাস্য রসেরে গল্প শোনা যায়। স্থানীয় মিডিয়া কর্মীরাও তার বিষয় অবগত হলেও কেউ এ বিষয় নিয়ে নড়া-চড়া দিয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আরজ আলী সম্পর্কে তার অতটা স্মরণ নেই। তার বিষয় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডরদের ভূমিকা রাখাটা অত্যাবশ্যক ছিলো। এখন তিনি বিষয়টি আমলে নেবেন। অনিয়ম থাকলে সেটিও দেখবেন। একই কথা বললেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশিষ কুমার।

তার দাবি, এ বিষয়ে আরজ আলীর পরিবারের পক্ষ থেকে গেজেটভুক্ত করতে কেউ আবেদন করেছে এমন কোন তথ্য অফিসিয়াল ফাইলপত্রে নেই। তবে এখন যদি কেউ আবেদন করে সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সত্যতা পেলে সুপারিশ করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু আরজ আলীর পরিবার বলছে ভিন্ন কথা। এখন মিডিয়ার খোচা-খুচিতে অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানা প্রতিশ্রুতি দেবেন, যেমনটি দিয়েছিলো মৃত্যুপূর্ব তার মাকে। স্থানীয় ক্ষমতাশীন দলীয় নেতা থেকে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দরজায় পৌঁছানো যেখানে দুরহ-দুঃসাধ্য, সেখানে স্বীকৃতি আদায়ে প্রতিশ্রুতি প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ সাধ্য নয়। আক্ষেপ-বিধাতাই জানে কবে মিলবে আরজ আলীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এমন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। নাকি তার আত্মায় বয়ে বেড়াবে এই আকুতি, পিছনে ফেলে আসা ৫২ বছরের প্রেক্ষাপট সে কথাই বলে।’

20 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন