৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

‘মেরুদণ্ডহীন’ সাংবাদিকতার শুরু কীভাবে?

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:০৬ অপরাহ্ণ, ০৩ মে ২০২১

‘মেরুদণ্ডহীন’ সাংবাদিকতার শুরু কীভাবে?

নিয়ন মতিয়ুল >> বদলে যাওয়া গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিরূপ চরিত্র নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরাই যে এভাবে প্রতিবাদমুখর হবেন, ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠবেন তা মনে হয় স্বপ্নেও কেউ ভাবেন নি। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সর্বজনীন হয়েছে সেই গণক্ষোভ। কেউ এটাকে প্রবল আত্মসমালোচনা বললেও কেউ আবার মাত্রাছাড়া প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখছেন। তবে বহুদিন ধরে তিল তিল করে পুঞ্জীভূত হওয়া এই ক্ষোভের সর্বব্যাপ্ত প্রকাশ বিব্রতকর হলেও একেবারেই আকস্মিক বা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়।

সাংবাদিক কমিউনিটির জন্য অসহনীয় এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে ‘মেরুদণ্ডহীন’ সাংবাদিকতার জন্য কে বা কারা দায়ী? সাংবাদিক, মালিকপক্ষ না অন্য কোনো মহল? আত্মসমালোচনামুখর সংবাদকর্মী ও সিনিয়র সাংবাদিকরা এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন । বিচ্ছিন্নভাবে নানা তত্ত্ব, তথ্য ও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সেসব বিশ্লেষণ করলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আলোচনায় আসতে পারে-

১. অতিরাজনীতিকরণ: দল বা রাজনীতি বিষয়ে সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীদের বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা কাঙ্ক্ষিত হলেও এটাই সত্য, দলীয় পক্ষপাতিত্ব বা প্রচ্ছন্নভাবে রাজনীতিবিদের মতো দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করে। বিগত শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকের স্বাধিকার আর স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বাপর গণমাধ্যমের অবিস্মরণীয় ভূমিকার মূলে সাংবাদিকদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছিল আশির্বাদের মতো। তবে গেল অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পেক্ষাপট বদলের পরেও সাংবাদিকদের প্রকাশ্য দলীয় পক্ষপাতিত্ব ও রাজনীতিবিদের মতো আচরণ পেশার নৈতিকতাকে একেবারেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

২. দলদাসত্ব: অতিরাজনৈতিক বোধ থেকেই সাংবাদিকদের দলদাসত্বের শুরু। দলীয় প্রধানকে নেতা বা কর্মীদের মতো করে সম্বোধন রীতি- অনেকের মধ্যে সেই দাসত্বেরই প্রমাণ মেলে। প্রবল দলদাসত্বের কারণেই দলীয় প্রধানসহ শীর্ষ নেতাদের সামনে নতজানু হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে দল বা দলীয় অপকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা কিংবা দলের কারণে রাষ্ট্রে, সমাজে বা সাধারণ মানুষের ওপর হওয়া অন্যায় জনসম্মুখে তুলে ধরার সাহসিকতা আর থাকে না। রাষ্ট্রপ্রধানের ডাকে গণভবনে গিয়ে তাই দলীয় কর্মীদের মতোই প্রশ্ন করতে দেখা যায় সংবাদকর্মীদের।

৩. বিভাজিত কমিউনিটি: অতিরাজনীতিকরণ আর দল দাসত্বের চূড়ান্ত পরিণতি সাংবাদিক কমিউনিটির বিভাজিতরূপ। যা নিরপেক্ষ আর সাহসী সাংবাদিকতার মূলে কুঠারাঘাত। প্রেসক্লাব বা পেশাদার সংগঠনে বহু বিভক্তি, বহু ফাটল। জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রেষারেষি, দ্বন্দ্ব, অন্তর্ঘাত, জনস্বার্থের ইস্যুতে পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে পড়া। যেখানে পেশার চেয়ে নেতাই বড় আর নেতা নির্বাচিত হয়েই দলীয় প্রধানের হাতে ফুল দিয়ে নতজানু হওয়ার মহড়া। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই বদল হয় নীতি, নেতা, সংগঠন। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও সেবাদাস হয়ে হঠাৎ গজিয়ে উঠতে থাকে মৌসুমী কিছু গণমাধ্যম। সেখানে যোগও দেন দলদাস, দলসন্ত্রাসী মৌসুমী সাংবাদিকরা! সরকারের সাফল্যের পাশাপাশি দল আর নেতাদের চরিত্র বন্দনার গাল-গল্পে ভরে ওঠে সেসব পত্রিকার পাতার পর পাতা। এতে গণমাধ্যম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মহৎ দৃষ্টিভঙ্গির গালে পড়তে থাকে চপেটাঘাত।

৪. বিজ্ঞাপনের রাজনীতিকরণ: সাংবাদিকদের অতিরাজনীতি, দলদাসত্ব, বিভাজিত কমিউনিটির হাত ধরে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও ঘটে পরিবর্তন। কোন বিজ্ঞাপনদাতা কোন রাজনৈতিক ধারার গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের বিজ্ঞাপন দেবেন সেটাও ঠিক করে ফেলেন। ফলে বিজ্ঞাপনের কোটি কোটি টাকার বাজারও হয়ে পড়ে বিভাজিত। আর জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় পাস না করেও সরকারি বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির কারণে অনেক গণমাধ্যম ও তার নীতিনির্ধারকরা জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে বধির হয়ে পড়েন। রাজনীতি আর ঐতিহ্য রক্ষাতেই সীমাবদ্ধ রাখেন তাদের সাংবাদিকতা, আমজনতার স্বার্থ দেখার ক্ষেত্রে অন্ধ থাকেন। যেখানেই বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি তার পক্ষেই সংবাদ, হোক তা জনস্বার্থবিরোধী– এমন ভয়ঙ্কর নীতির প্রতি দুর্বলতা যত বাড়ে, ততই কমতে থাকে গণমাধ্যমের নৈতিকতা।

৫. গণমাধ্যম মালিকদের মওকা: রাজনৈতিক সংঘাত, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসীদের উৎপাতে নিজেদের ব্যবসা নির্বিঘ্ন রাখতে সর্বদা জটিল সংকটে থাকা শিল্পপতি আর ব্যবসায়ীরাও সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির কাছে বার বার ধরাশায়ী হয়ে তারা আরও বড় শক্তির সন্ধান করেন। অবশেষে গণমাধ্যমের প্রবল নৈতিক শক্তিকেই কাজে লাগানোর জন্য উঠে পড়ে লাগেন। এজন্য গণমাধ্যম খাতে বিশাল বিনিয়োগও করেন। তবে সাংবাদিকদের অতিরাজনীতিকরণ, দলদাসত্ব, বিভাজিত কমিউনিটির কারণে গণমাধ্যমকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হয়। তাছাড়া বিভাজিত বিজ্ঞাপনের আয় থেকে বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত কিংবা গণমাধ্যমের ব্যয় তোলাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। কৌশলে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেন সাংবাদিকদের নৈতিকতা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কাজে লাগাতে থাকেন তাদের। জীবন-জীবিকার কাছে পরাজিত হতে থাকে গণমাধ্যমের নীতি নৈতিকতা।

৬. প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি: নৈতিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার মাধ্যমে গণমাধ্যমের শক্তি সাহস বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সাংবাদিকদের প্রথাগত অতিরাজনীতিবোধ আর দলদাসত্ব। গণমাধ্যমকে জনপ্রিয় করে বিজ্ঞাপনী আয় বাড়িয়ে মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষির শক্তি অর্জনে সক্ষম হয়ে উঠতে পারেন না বেশিরভাগ সাংবাদিক নেতা বা সম্পাদকেরা। তাদের ষাট বা সত্তর দশকের সাংবাদিকতার মডেলে পরিচালিত গণমাধ্যম তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতেও পারে না। আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে গণতন্ত্র আর সুশাসনের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে গণমাধ্যমকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা ব্যর্থ হন। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৃষ্ট এই ব্যর্থতা ঢেকে গণমাধ্যমে নিজেদের পেশা বা চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে বিনিয়োগকারীদের সব শর্তে রাজি হতে থাকেন।

৭. অদক্ষ ও মেরুদণ্ডহীন সম্পাদকীয়: অতিরাজনীতি, দলদাসত্ব আর বিভাজিত কমিউনিটির সবদিক সামলে অস্তিত্ব ও আর বিনিয়োগকারীদের মন রক্ষা করে চলার অদ্ভুত দক্ষতা অর্জন করলেও বেশির ভাগ সম্পাদকই সৃজনশীলতার পথ তৈরি করতে পারেন না। সবদিক সামলে কোনো ইস্যুতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও চমক দেখাতে পারেন না। হৈচৈ ফেলে দেয়ার মতো কোনো প্রতিবেদন তৈরির পেছনে তেমন শ্রমঘাম দেয়ারও উদ্যোগ দেখা যায় না। মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষার বিশেষ শর্তেই নিয়োগ লাভ করেন বেশিরভাগ সম্পাদক। আবার বেশিরভাগ সম্পাদকের কক্ষে অতি জরুরি প্রয়োজনেও তাৎক্ষণিক প্রবেশ করতে পারেন না কোনো প্রতিবেদক কিংবা ব্যবস্থাপক। মফস্বল সাংবাদিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও চরম নাজেহাল করার অভিযোগও উঠে আসে প্রায়ই। একইভাবে তাদের চরম অদক্ষতার কারণেই গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে বৈষম্যহীন ব্যবস্থাপনা বা কর্মীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির নজিরও তেমন দেখা যায় না।

অবশ্য, বিনিয়োগকারীরা যেভাবে গণমাধ্যমকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছেন তাতে গণমাধ্যমের শক্তিমত্তা দিন দিন দুর্বল হতে বাধ্য। আর সেক্ষেত্রে আজকের ‘গর্বিত গণমাধ্যমকর্মীরা’ তাদের গণমাধ্যম ছেড়ে চলে গেলে সেই দুর্বল গণমাধ্যম তাদের কতটা সুরক্ষা দেবে সেটা ভেবে দেখা জরুরি।

আর টকশোতে জ্বালাময়ী নৈতিক বক্তব্য দিয়ে জাতিকে সম্মোহিত করার চেয়ে নিজ নিজ সংবাদমাধ্যমকে জনপ্রিয় ও সাহসী করে তোলা এখন সময়েরই দাবি। ডিএফপিতে দেয়া মিথ্যা প্রচার সংখ্যার তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া বিজ্ঞাপনের অর্থে তেলাপোকার মতো বেঁচে থাকার চেয়ে জনপ্রিয় ও সাহসী হয়ে সিংহের মতো বেঁচে থাকাই কিন্তু সাংবাদিকতা।

তাই দলদাসত্ব বা বিনিয়োগকারীদের হাতের টিস্যু হিসেবে নয়, নিজস্ব শক্তিমত্তা আর নৈতিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে সিংহের মতো সাহসী হলেই কেবল গণমাধ্যম ফিরতে পারে তার স্বরূপে, নতুন ইতিহাস হয়ে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে এমন প্রত্যাশা সব গণমাধ্যমকর্মীরই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন