৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

লিটন বাশারকে জানি, সংবাদের ইনট্রো’র মতো

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ, ০২ জুলাই ২০১৭

সদ্য প্রয়াত লিটন বাশারের মৃত্যু কি বরিশাল মিডিয়া অঙ্গনের জন্য খুব ভারি হয়ে উঠছে ? না কি লিটনের নানা কর্মকান্ডের ফিরিস্তিগুলো সংবাদের ইনট্রো’র মতো সত্যি কিছু সারসের পালক হয়ে উড়ছে, আমাদের চারপাশের হাল্কা হাওয়ায় ওর জীবনের বিবর্তন, উত্থান-পতন এবং উল্লম্ফন। আপাতত, এইসব তর্কবিতর্কের পরিবেশ কখনো ঘূর্নি হয়ে বইছে। আবার, কারো কারো আবেগে শান্ত বসন্তের শুনশান কষ্ট বইয়ে দিচ্ছে তপ্ত দাবদাহের ভেতর।

তাহলে, লিটন বাশারের চমৎকার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয়েছিল জনাব হোসেন শাহ সম্পাদিত দৈনিক শাহনামা পত্রিকার মাধ্যমে। নব্বই দশকের শুরুর দিকে, এই রিলেরেসের কাঠিটা ওর হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় গল্পকার আজাদ ভাই। (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী : নসরত শাহ্ আজাদ)। সেই সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শাহনামা আফিসে আজাদ ভাইকে ঘিরে এলোমেলো একটি সাহিত্যের আড্ডা হতো। তখন, যতোদিন আমি ওই আড্ডায় গিয়েছি, ততোদিনই দেখেছি : একটি লম্বা রুমের পার্টিশন দেয়া খলফার বেড়ার ওপাশে, টেবিল-চেয়ারে বসে নিবিড়ভাবে লিটন-ওর রিপোর্ট লিখছে। আবার, কখনো দেখতাম, সংবাদ লেখার কাজ শেষ করে আমাদের আড্ডার কোণে এসে, গুটিসুঁটি বসে শুনতো, তখনকার আড্ডায় আলোচিত কবিতা গল্প লেখার পাঠ।

আমার ধারণা, সেই সময়ের ওই আড্ডাগুলোর আনুপুঙ্খ  স্রোতা হয়ে থাকার কারণেই লিটন বাশারের রিপোর্টগুলো ব্যাতিক্রমী ছিলো এবং সেগুলো বরাবরই সাহিত্যের ভাষায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠতো। এবং আমরা যারা, ওর লেখার নিয়মিত পাঠক, তারা সকলেই জানি যে, বিভিন্ন বিষয়ের ফিচারগুলো লেখার আচ্ছন্নতায় নানা কবিতা-গানের উপমায় অনবদ্য হয়ে উঠতো বাক্যের সমাহার। কিংবা কোনও গল্পের চরিত্রের মতো হয়ে উঠতো লিটনের বিভিন্ন লেখার সুকৌশলে।

লিটনের লেখার বিশেষত্বের কারণ ছিলো, ওর…যে কোনও লেখাকে- তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলতে, এ বিষয়ে সে বেশ অনুসন্ধানি ছিলো। তাই, মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন করতো এবং প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু জেনে নিতো অবলীলায়। যদিও, বিশেষ অনুরোধে, ওর দরকার অনুযায়ী কখনো কখনো দুর্লভ সংগ্রহের বইটিও সরবরাহ করেছি। কিন্তু সেসব ২/১টি ফেরত পেলেও, তার অতি প্রয়োজনীয় বইটি আমাকে সে ফেরৎ দেয়নি আজও। এটি ওর জীবনের কোনও দুর্ণাম নয়। দোর্দন্ডের সাথে বলবো, জ্ঞান অনুসন্ধানের প্রয়োজনে লিটন বাশারের মতো গ্রন্থগায়েব- গৌরবের কাজটি আমিও আগোচরে অনেক করছি।

তাহলে, লিটন বাশারের জীবনসংর্ঘর্ষ কতোটা স্পর্শকাতর শিল্পের জায়গায় ছিলো ? সেগুলো তার চিন্তায় ও লেখায় এবং করে যাওয়া সামগ্রিক কাজের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। খুব বড় মাপের হৃদয় ছাড়া বাস্তবকে শিল্পের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই, ওর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব কিছুটা বিতর্কের হলেও, পেশাজীবি নেতৃত্বের অনেক কিছুই এখন আমরা তার সত্ত্বার গভীর থেকে দেখতে পাই। তবুও হয়তো, প্রকাশিত মহত্বের অনেক কিছুই মুছে ফেলতে পারি না আমরা।

নব্বইয়ের শেষ দিকে আমাদের জনপ্রিয় কবিদের তুমুল প্রেমের কবিতা দিয়ে এক প্যাকেট ‘কবিতার কার্ড’ প্রকাশনাগুলো তরুণ প্রেমিক/ প্রেমিকাদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। লিটন বাশারসেই তারুণ্যের অধিকারী ছিলো। তাই, সেইসব কাব্য আঙ্গিকের জনপ্রিয় ধারায় নিজের বিয়ের ( লিটন-আরজু বিয়ে উত্তর সংবর্ধনা ) কার্ড ছাপিয়ে আত্মীয় বন্ধু শুভাকাঙ্খীদের মাঝে বিলি করে, অন্যতম, অনন্য অসাধারণ এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। বরিশালে এই ধারার ব্যাতিক্রমী কাজ একমাত্র ওর বিয়েতেই ঘটেছিলো। অন্তত, প্রিয় শিল্পী উত্তম দাসের অলংকরণে মুদ্রিত নিমন্ত্রণপত্রটির সেই চমৎকারিত্বের মুগ্ধতয় আজও সে কার্ডটি সযত্নে আমার সংগ্রহে রেখেছি।

লিটনের বিয়ের পর আরজুর সঙ্গেও আমাদের পারিবারিক হৃদ্যতা আরও বেশ দৃঢ় হয়েছিল। আমাদের একমাত্র মেয়ে চিনতীর খুব প্রিয় ছিলো এই বাশার আন্টি। ক্রিসমাসের গভীর রাতের ফুসরত ছাড়া ওরা আমাদের বাড়িতে আসতে পারতো না। কেননা, বরিশাল প্রেস ক্লাবের নির্বাচনটি তাদের বাঁধাধরা নিয়মে প্রত্যেক ২৫-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতো বলেই, এমোনটি ঘটতো প্রতি বছরেই। ওদের সন্তান জন্মের পর পারিবারিক অসাটা কমলেও, প্রতি ক্রিসমাসে একটি বিশেষ মাংসভূনার লোভে লিটনের অসাটি থামে নি। যদিও, ক্রিসমাসের গিফট হিসেবে প্রতি বছরই আমার জন্য হুইস্কি/ জিন/ ভদকা, এমনি যে কোনও ব্রান্ডের একটি পানীয় নিয়ে আসতো, কিন্তু সেই ওয়াইন সে কোনও বড়দিনেই পান করতো না। তবে, ওই দিন ক্রিসমাস উৎসবের জন্য, কিসমিস অথবা অন্য কোনও ফলের গাঁজলা দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে পর্তুগীজ রেসিপিতে তৈরি হোম মেইড ওয়াইন খেতেই বেশ স্বাচাছন্দ বোধ করতো।

দৈনিক দখিনের মুখ প্রকাশের প্রথম মিলাদের দিন সন্ধ্যায় ওর অফিস রুমে নিয়ে গিয়ে আমাকে সপ্তাহের যে কোনও একদিন সাহিত্য পাতা সম্পাদনার কথা বলেছিল। তখন অফিসের কাজের অজুহাত দেখিয়ে কাজটি আমি করিনি।

কদিন আগেও ফোন করে ওর আফিসেডেকে নিয়ে বলেছিল :“এবার আমাদের কাগজের সাহিত্য পাতাটি করেন। এখন তো আপনার অনেক সময়”…:- ভেবে বলছি, বলে সে দিনও আমি ওর প্রস্তাব এড়িয়ে এসেছি।”
——————————–
লেখক, কবি ও লিটলম্যাগ কর্মী

 

10 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন