২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বৈশ্বিক উষ্ণায়নে করোনা: মানবজাতিই আত্মবিধ্বংসী

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:০৪ অপরাহ্ণ, ০৪ জুলাই ২০২১

বৈশ্বিক উষ্ণায়নে করোনা: মানবজাতিই আত্মবিধ্বংসী

নিয়ন মতিয়ুল >> প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সভ্যতাবিধ্বংসী মহাবিপর্যয় এসেছে বার বার। মানবসভ্যতার সব অর্জন, অগ্রগতি উলট-পালট করে দিয়ে গেছে। মহাকালে হারিয়ে গেছে কত নাম না-জানা সভ্যতা। তবে আজকের করোনাবিপর্যয় আধুনিক সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময়। যখন আমরা মহাকাশ জয়ের সুবর্ণকালে, পৃথিবীর বাইরে সভ্যতার দ্বিতীয় কলোনি বানাতে মরিয়া- ঠিক সেই মুহূর্তে এই দুর্যোগ থমকে দিয়েছে সবকিছু। সভ্যতার অর্জিত সমস্ত মুক্তজ্ঞান, প্রবল আত্মবিশ্বাসকে বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি করিয়েছে। হয় জয়, নয় ধ্বংস-এমন বার্তাই দিচ্ছে করোনা।

আবার করোনার চলমান প্রাণঘাতী তাণ্ডবের মধ্যেই বিশ্ববাসী মুখোমুখি হচ্ছে আরো ভয়াবহ সব বিপর্যয়ের। যে বিপর্যয় গোটা মানবসভ্যতার অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। একইসঙ্গে আকস্মিকভাবে মানবপ্রজাতিকে বিধ্বংসী পরিস্থিতির মুখোমুখি করার বার্তাও দিচ্ছে। বিপদের সেই পদধ্বনি কানে বাজলেও অনেক ক্ষেত্রে নির্বিকার মানবসমাজ আর বিশ্বনেতারা।

করোনা বিপর্যয় কিংবা এর দীর্ঘ স্থায়িত্বের সঙ্গে বিশ্বউষ্ণায়নের যোগসূত্র অনুসন্ধানে বিস্তারিত গবেষণা এখনও হয়নি। সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে দেশে আবিষ্কৃত টিকার বিশ্বব্যাপী সুষম বণ্টনের বিষয়টিও অনিশ্চিত। আবার করোনার নতুন নুতন ভ্যারিয়েন্ট পরিস্থিতিকে কতটা বেসামাল করতে পারে আর তা সামলানোর সক্ষমতা কিংবা আত্মবিশ্বাস আমরা কতটা অর্জন করেছি তা-ও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন।

করোনা ভাইরাসের চলমান তাণ্ডবের মধ্যেই বিশ্বউষ্ণায়নের নগ্নরূপ সভ্যতাকে আরেক মহাবিপদের সংকেত দিচ্ছে। মেরু থেকে শুরু করে শীতপ্রধান অঞ্চলে ‘হামলে’ পড়ছে ভয়াবহ তাপদাহ (হিটওয়েব) বা হিটডোম। সেই সঙ্গে অনেক শান্ত অঞ্চলেও দেখা দিচ্ছে ঘন ঘন প্রবলমাত্রার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব। চরিত্র বাদলাচ্ছে ভূমিকম্পও। এসব বিপর্যয়ে ইতোমধ্যে মৃত্যু অথবা উদ্বাস্তুর সংখ্যা রেকর্ড ভাঙছে।

বিশ্বউঞ্চায়নের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত এবার দেখা গেল প্রবল শীত ও তুষারপাতে অভ্যস্ত দেশ কানাডাতে। সেখানে স্মরণকালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (৪৯.৬) রেকর্ড হয়েছে। তাপে পুড়ে যাওয়া সেই অঞ্চলকে গ্রাস করছে ভয়ঙ্কর দাবানল । আবার যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ড এয়ারপোর্টেও সম্প্রতি রেকর্ড হয়েছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (৪৬.১)। অস্বাভাবিক এই তাপদাহে দেশ দুটিতে শত শত প্রাণহানী ঘটছে।

দাবদাহ বা হিটডোমের ছোবল দেখা দিয়েছে ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ আরো অনেক দেশ ও অঞ্চলে। আবার বিশ্বউষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রাও অনেক আগে থেকেই বাড়ছে উদ্বেগজনকহারে। যে কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছেই। গেল বছরে দক্ষিণ মেরুর অ্যান্টার্কটিকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (১৮.৩) রেকর্ড করা হয়। যা বিশ্বউষ্ণায়নের ফল বলছেন বিজ্ঞানীরা। ক্রমাগত এসব বিপর্যয়ে টিকতে না পেরে প্রাণিজগতের বহু প্রজাতি এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

তবে বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানবসভ্যতার নিজস্ব ও স্বসৃষ্ট সংকট। দেশে দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, বাকস্বাধীনতার চরম বিপর্যয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ সম্পদের সুষম বণ্টন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নীতিবোধ বা মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ আরো বেশি একরোখা, সহিংস হয়ে উঠছেন রাজনীতি ও সমাজের নেতৃত্বদানকারীরা। মানবজাতির হিংসা ও চরম ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তির বড় দেশে দেশে ক্রমাগত আধুনিক মারণাস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি।

এই মুহূর্তে বিশ্বে যে পরিমাণ পারমাণবিক মারণাস্ত্র মজুদ রয়েছে তাতে কয়েকশ বার ধ্বংস করা যাবে পৃথিবীকে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘সেটা জানি না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ যে লাঠি এবং পাথর দিয়ে হবে তা বলতে পারি’। তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ করার মতো কেউ যে থাকবে না আজ তিনিই হয়তো বলতেন।

আবার, মানবজাতির চাহিদার ২০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকা পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন বন উজার করার আগ্রাসন চলছে গেল কয়েক দশক ধরে। পেনিসিলভেনিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জেম্‌স্‌ এল্‌ককের আশঙ্কা আমাজান অরণ্য আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে। শিল্প, চাষাবাদ আর বিশ্ববাজারে মাংসের যোগান দিতে ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট আমাজনকে বলির পাঠা বানিয়েছেন।

বিশ্বউষ্ণায়নের সঙ্গে মানবপ্রজাতির মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের যোগসূত্র অনুসন্ধান করছেন বিজ্ঞানীরা। তবে করোনার ভয়াবহতা যে মানবপ্রজাতির ধ্বংসাত্মক প্রবণতা নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে তা এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। করোনাকালীন গেল আট মাস ধরে চলা সংঘাতের জের ধরে ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলের চার লাখ মানুষ যে দুর্ভিক্ষের শিকার আর ১৮ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে- এটাই এর বড় দৃষ্টান্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বউষ্ণায়নের ভয়াবহতার সঙ্গে অভিযোজনের কৌশল রপ্ত করতে ব্যর্থ হলে সভ্যতার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর অভিযোজনের সবচেয়ে ভালো উপায় জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধিসহ টেকসই উন্নয়নের সহায়ক পরিকল্পিত নগরায়ণ। তবে তার আগে ইতি টানতে হবে প্রকৃতির ওপর মানুষের ভয়াবহ আগ্র্রাসনের। দলমত, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে এই মহাবিপর্যয় ঠেকাতে। না হলে ভয়াবহ পরিণতির ফল ভোগ করতে হবে সবাইকেই।

তবে বিজ্ঞানীদের এই সতর্কবাতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই চলেছেন বিশ্বনেতারা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক বা পরিকল্পনাকারীরাও উপেক্ষা করছেন এসব। তারা অনেক সময় ধর্মীয় নেতাদের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। রাজনীতিকরা অদৃষ্টের ওপর ন্যস্ত করছেন সবকিছু। মূলত, যে হারে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সভ্যতার বিপদ সংকেত দিচ্ছে, একইহারে মানবজাতি জড়িয়ে পড়ছে সরব-নীরব বহুমুখী আত্মঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির লাগামছাড়া আচরণ আর বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে সুপার পাওয়ার দেশগুলোর হুংকার অশান্তির বার্তাই শুধু দিচ্ছে।

অন্যদিকে, সভ্যতার জন্য বিপজ্জনকখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেডিসেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারোর অনুসারী রাজনীতিকের সংখ্যা দেশে দেশে হু হু করে বাড়ছে। অনেকক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের মতো নেতারা সুপারস্টারে পরিণত হচ্ছেন। ক্ষমতা আর নির্বাচনমুখী রাজনীতিকদের হাত ধরে ট্রাম্প-বোলসোনারোদের স্বর্গে পরিণত হচ্ছে আজকের বিশ্ব। বেশিরভাগ গণমাধ্যমই এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিপজ্জনক রাজনৈতিক দর্শনে। বিজ্ঞানী বা দার্শনিকদের নয়, তারা শোবিজ কিংবা স্পোর্টস পারসনের বানাচ্ছে সুপারস্টার। যার প্রধান অস্ত্র সামাজিক মাধ্যম। এসব কারণে সভ্যতার সামাজিক মানসিকতারও বদল ঘটছে। প্রযুক্তি, জ্ঞান বা দর্শনমুখী দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে অর্থ-ক্ষমতা আর রাজনীতিমুখী প্রবণতা বাড়ছে। গোটা সমাজ-সভ্যতাই হয়ে উঠছে আত্মবিধ্বংসী।

(৪ জুলাই, ২০২১। এলিফেন্ট রোড, ঢাকা)

11 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন