২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

আভিজাত্যের ‘সাংঘাতিকতা’য় আক্রান্ত গণমাধ্যম

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:৫৯ অপরাহ্ণ, ০৫ জুন ২০২১

আভিজাত্যের ‘সাংঘাতিকতা’য় আক্রান্ত গণমাধ্যম

নিয়ন মতিয়ুল >> বেশ কিছুদিন আগের কথা। সংবাদকর্মীদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে একটি পত্রিকায় আন্দোলন চলছিল। বেতন-ভাতা না পেয়ে অনেকেই চাকরি ছাড়ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিল, ‘সাবেক কর্মীদের সঙ্গে বর্তমান কর্মীদের যোগাযোগ নিষিদ্ধ’। এতে বিস্মিত হয়ে পড়লেন বর্তমান-সাবেক দু’পক্ষই।

বিস্ময়ের এমন ঘোরের মধ্যেই কদিন আগে একটি অনলাইনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির কথা শোনা গেল। বার্তাকক্ষের অযৌক্তিক চাপ আর ‘মানসিক নির্যাতনের’ শিকার কয়েকজন কর্মী সেই গণমাধ্যম কার্যালয় ত্যাগ করতে শুরু করলেন। পরিস্থিতি সামলাতে ‘বিগবস’ নোটিস দিলেন, ‘হাউজ ত্যাগ করা সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই চাকরি নট’।

এসব ঘটনার মধ্যেই আরেকটি ঘটনা কানে এলো। ঐতিহ্যবাহী এক পত্রিকা থেকে চাকরি ছেড়ে দেয়ার অপরাধে এক সংবাদকর্মীকে অন্য পত্রিকায় যোগদানে বাধা দেয়া হয়েছে। শত চেষ্টার পরেও কোনো গণমাধ্যমে চাকরি করতে না পেরে বেকার হয়ে বাসায় দিন কাটছে ওই কর্মীর।

এসব ঘটনায় আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সাংবাদিকতা কি গার্মেন্টস না জাহাজ ভাঙা শিল্প হয়ে গেল? যেখানে সংবাদশ্রমিকদের কোনোই স্বাধীনতা নেই। বঞ্চনা আর মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করা যাবে না! এমন কি চাকরি ছেড়ে দেয়াও অন্যায় কাজ! এ কেমন গণমাধ্যম আমাদের? কেমন ব্যবস্থাপনা? কারা, কীভাবে এসব ব্যবস্থাপনা চালাচ্ছেন?

আরেকটি অনলাইন সম্পর্কে এক খবর পাওয়া গেল। বিশেষ এক ‘রহস্যময়’ কারণে মধ্যম পর্যায়ের বিশেষ এক সংবাদকর্মীর হাতে ব্যবস্থাপনার পুরো ভার বিশেষভাবে তুলে দিয়ে নির্ভার হতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ‘বিশেষ এক বস’। প্রায় সব কর্মীই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আর বিশেষ সেই অনলাইনটি এখন আইসিইউতে মৃত্যুশয্যায়। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ‘ঢুলুঢুলু আবেগময়’ ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই বিশেষ সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠা সেই বিশেষ গণমাধ্যম এখন বিরাণ মরুভূমি। এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিশেষ শোক জমছে।

আবার এমন সব খবরের পাশাপাশি মফস্বল সাংবাদিকতার একটি ঘটনা নিয়ে কদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে চলছে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক। একটি আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) টিভির কর্মকর্তার সঙ্গে জেলা প্রতিনিধির ফাঁস হওয়া অডিও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মোটা টাকা দানের (ডোনেশন) বিনিময়ে জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সেই সাংবাদিক বেতন তো পাচ্ছেনই না, উপরন্ত সংবাদ প্রকাশের বিনিময়ে মাস মাস অফিসে টাকা পাঠাতে হচ্ছে। এ নিয়ে কথা বলতে গিয়েই বিপাকে পড়েছেন সেই সংবাদকর্মী। সেই অডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকটা ভাইরাল হওয়ায় চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন তিনি।

এ ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, রাজধানীর চেয়ে ভয়াবহ বিপদে রয়েছেন মফস্বল সাংবাদিকরা। রীতিমত চাঁদাবাজির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তাদের। সৎ-সাহসী সাংবাদিকতা চাপা পড়ছে ব্যাঙের ছাতার মতো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী সাংবাদিকতার মহামারিতে। নীতি-নৈতিকতা বুক পকেটে (নারীদের ক্ষেত্রে ভ্যানিটি ব্যাগে) রেখে রাজধানীর কথিত সব গণমাধ্যম কার্যালয় থেকে চড়ামূল্যে পরিচয়পত্র কিনছেন। এরপর অফিসের নির্দেশেই সকালে বের হচ্ছেন খালি পকেটে! রাতে বাড়ি ফিরছেন পকেট ভরে! আর চাঁদাবাজির টাকার সিংহভাগ অফিসে পাঠাতে বাধ্য হতে হচ্ছে। সাংবাদিকতার কি আশ্চর্য বাণিজ্যিকায়ণ! সন্ত্রাসী, চোর, ছিনতাইকারী আর বাটপাররা এমন বিস্ময়কর সুযোগকে লুফে নিচ্ছেন।

এখন আপনি গণমাধ্যম পরিচালনা কিংবা এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। বলতেই পারেন, অমানবিক, স্বার্থপর, মেরুদণ্ডহীন, বিপজ্জনক ব্যবস্থাপনার কারণেই গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আজও দাঁড়ায়নি। হাত-পা, মেরুদণ্ড ভাঙা অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আর তাতে জ্বালানি দিচ্ছেন তথাকথিত ‘বিগবসেরাই’। যারা জাতিকে কথার জাদুতে মুগ্ধ করেন, সম্মোহিতও করেন। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই উল্টো চরিত্র ধারন করেন। কর্মীদের প্রতি মানবিক আচরণের পরিবর্তে অনবরত অপদস্ত, অপমান, মানসিক নির্যাতন করে চলেন। একান্ত ব্যক্তিগত চারিত্রিক খেয়াল খুশিমত আচরণ করেন। যা নিয়ে মুখ খোলা বারণ। ব্যবস্থাপনাবিষয়ক শূন্যজ্ঞান আর প্রবল কর্তৃত্ববাদিতার জন্যই গণমাধ্যমে কর্মীবান্ধব সৃজনশীল পরিবেশ বা আধুনিক ব্যবস্থাপনার মডেল আজও গড়ে তুলতে পারেননি তারা।

আবার, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যমের বিশেষ এক গোষ্ঠীর বিশেষ অভিজাততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এমনই দৃষ্টিভঙ্গির বড়মাপের (পদে) এক সাংবাদিক এক প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, দেশে কালের কণ্ঠসহ চারটি মাত্র পত্রিকাকেই মূলধারা (মেইনস্ট্রিম) হিসেবে ধরা যায়। জোর দিয়ে বলেছেন, এর বাইরে আর কোনো মূলধারা নেই। তালিকায় সমকাল, যুগান্তর ও প্রথম আলোর বাইরে আর কোনোটিকে রাখতে নারাজ। সুপিরিয়র কমপ্লেক্সে ভোগা ‘উঠতিখ্যাত’ সেই বস চাকরি দেয়ার জন্য স্বনির্বাচিত মূলধারার বাইরে আর কাউকে বাছাই করতে আগ্রহী নন। তাছাড়া এসব পত্রিকার বাইরের অভিজ্ঞতাকে আমলে নিতেও তার চরম অনীহা।

সেই বসের এমন দৃষ্টিভঙ্গিই বলে দেয়, যারাই উচ্চ বেতন দেয় তারাই মূলধারা। এক সময় সংবাদ, ইত্তেফাক কিংবা পরবর্তীকালের ভোরের কাগজ মূলধারা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বেতন কম দেয়ায় তারা তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে। একটি অতিঅভিজাত ধারার পত্রিকায় কাজ করে উচ্চমাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনকারী সেই সাংবাদিক নাকি মূলধারার বাইরে সাংবাদিকতায় দশ/বার বছরের অভিজ্ঞদের শিক্ষানবীশ হিসেবে গণ্য করছেন। এতে অবশ্য বেতন কম ধরার ধামাকা সুবিধা পাবেন তিনি।

এখন আপনার যদি মনে হয়, বিগত শতকের রাজনৈতিক সাংবাদিকতার যুগ আর নেই; অনলাইন এখন নতুন দিগন্ত প্রসারিত করেছে, আর সেজন্য গণমাধ্যমে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, তাহলে আপনি ‘আকাশ কুসুমই’ ভাবছেন। কারণ, উপরের ঘটনা থেকে অবশ্যই বুঝতে পারছেন মদের বদল হয়নি, শুধু বোতলটার রঙই পাল্টে গেছে। মুষ্টিমেয়তন্ত্রে বিশ্বাসী কিছু নির্বাচিত সাংবাদিকই যে হাতে গোনা কয়েকটি গণমাধ্যমকে মূলধারা মনে করবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। তাতে অভিজাত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসীদের মান সুরক্ষিত হয়। শিল্পপতিদের বগলদাবা করে প্রবল দাপট আর প্রভাব খাটিয়ে বিপুল সম্পদ অর্জনের নিশ্চয়তা থাকে শতভাগ।

এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি খবর আপনাকে নতুন কিছু ভাবাতে পারে। কলেজছাত্রী মুনিয়াকাণ্ডের ধারাবাহিক সংবাদ তো নেই-ই, মামলার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতির তথ্যও জানাচ্ছে না তেমন কোনো গণমাধ্যম। এমনকি সেই মহান মূলধারাগুলোও। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধছে। বলা হচ্ছে, রোজিনা ইসলামকে নিয়ে যতটা প্রতিবাদমুখর আন্দোলন দেখা গেল তাতে গণমাধ্যমের শক্তিমত্তা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাই পেয়েছেন আমজনতা। তবে মুনিয়াকাণ্ড নিয়ে কেন কথা বলা হচ্ছে না- সেটাই বড় বিস্ময়। ঠিক এমনই এক বিস্ময় জাগানো পরিস্থিতির মধ্যেই মুনিয়াকাণ্ডে দায়ের হওয়া মামলার প্রধান আসামিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে জাতির চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকরা।

গণমাধ্যমের সোনালি অতীতের মোহ যদি আপনার না কাটে তাহলে এসব ঘটনায় আপনি ভয়াবহভাবে হতাশ হয়ে পড়বেন। ভাববেন ‘সাংবাদিকতা শেষ হয়ে গেল’। ‘দেশে সাংবাদিকতা বলে আর কিছুই থাকলো না’। এভাবে যদি অবিরত ভাবতেই থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে মনে রাখতে হবে, মূলত ‘শেষ’ বলে কিছু নেই। ‘শেষ’ মানেই নতুন কিছুর শুরু। আসলে এই ‘শেষ’ থেকেই আধুনিক ধারার সাংবাদিকতা শুরুর সময় এখনই।

বলা যায়, বিগত শতকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত রাজনৈতিক সাংবাদিকতার দাপট যেমন ছিল, প্রয়োজনও ছিল ততটাই। তবে নব্বইয়ের পর বস্তুনিষ্ঠ আর সাংস্কৃতিক বিপ্লব কেন্দ্রিক সাংবাদিকতাই হয়ে উঠেছিল বেশি প্রাসঙ্গিক। এরপর চলতি শতকের শূন্য দশকজুড়ে করপোরেট হাওয়ায় ভেসে গণমাধ্যমের পুরো চরিত্রই গেছে বদলে। আর গেল এক দশকে তো অনলাইন আর মাল্টিমিডিয়াভিত্তিক সাংবাদিকতার বিপ্লব ঘটে গেছে বিশ্বে। হার্ড কপির জায়গা দখল করে নিয়েছে সফট কপি। ছাপা পত্রিকা ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সামনে অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে অনলাইন সাংবাদিকতা।

অথচ ষাট-সত্তর দশকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আমরা নতুন প্রজন্মের অনলাইন সাংবাদিকতার টিকিটিও ধরতে পারিনি। কারণ ওই একটাই- কালের বিবর্তনে প্রযুক্তির অনিবার্য জোয়ার আসে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ডাক আসে, বিশ্ব বদলে যায়, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়, নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়- আর আমরা হাঁটি পেছন দিকে। ধনী হই, চারদিকে সুউচ্চ অট্টালিকা দাঁড়িয়ে যায়, জীবনযাত্রার মান (পড়ুন-ব্যয়) বাড়ে, রাজনীতিকদের গলা চড়তে থাকে আর আমরা সেই তালে উটপাখি হতে থাকি। কমে যায় জীবনের দাম, লোপ পেতে থাকে আত্মসম্মান, অন্ধবিশ্বাসে চাপা পড়তে থাকে শিল্প-সংস্কৃতি, মৌলবিজ্ঞান, ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে উন্মুক্তদৃষ্টি।

আর রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নেয় কিছু হিপোক্রেট, পশ্চাৎপদ আর অপরাজনীতির ধারকবাহক আর স্থুলবুদ্ধির বুদ্ধিবিক্রেতারা। যারা নতুন প্রজন্মকে পড়তেই পারেন না। নীতি-আদর্শকে যারা চাপিয়ে দেন, উন্মুক্ত আকাশ থেকে বেছে নিতে বলেন না। যারা প্রজন্মকে আগামীর জন্য তৈরি না করে দৈবের ওপর ছেড়ে দেন। বিশ্বায়নকে ‘না’ বলেন অথচ দরজা-জানালা খুলে রাখেন আকাশ দেখার জন্য।

সত্যিই, বর্তমানকে জয় করা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নেই আমাদের। নতুন প্রজন্মের সামনে কোনো ‘আদর্শ’ও দিতে পারিনি। তারা বেড়ে উঠছে আদর্শহীন অন্ধকারে। তাদের গিলে খাচ্ছে অসত্য, অর্ধসত্য, ধর্মান্ধতা। তাদের আলোয় আনার দায়িত্ব আমাদেরই। আর গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে তার উর্বর ক্ষেত্র। অথচ সেই গণমাধ্যমের সামনেই ঘন অন্ধকার ঝুলে আছে। যারা এ অন্ধকার সরিয়ে আলো আনবে তারা আজ কোণঠাসা। তারপরেও বড় সংকটেই বড় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়। আর নতুন দিনের সম্ভাবনার বার্তা আসে নতুনদের হাত ধরেই।

(গণমাধ্যম ভাবনা: ৫ জুন, ২০২১। এলিফেন্ট রোড, ঢাকা।)

8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন