৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

আহমেদ মুন্না’র কলামঃ ইতিহাসের দায়মুক্তি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫১ অপরাহ্ণ, ২৫ মার্চ ২০২২

আহমেদ মুন্না’র কলামঃ ইতিহাসের দায়মুক্তি

সবাই স্রোতে গা ভাসায় না। কেউ কেউ স্রোতের বিরুদ্ধেও দাঁড়ায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে। লোভ এবং ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হয়ে একাই লড়াই করে। নীতিভ্রষ্ট সুবিধাবাদীদের রাজ্যে তাদের বোকা কিংবা পাগল বলে অভিহিত করা হলেও ইতিহাস একদিন ঠিকই সেসব অকুতোভয় মহানায়কদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত সম্মানে পুরস্কৃত করে। তেমনই এক অকুতোভয় জীবন্ত কিংবদন্তির নাম সিরাজ উদদীন আহমেদ।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরদিন ঘাতকচক্র যখন দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয় তখন বঙ্গবন্ধুর বহুদিনের বিশ্বস্ত আর অনুগত প্রায় সবাই একযোগে চুপসে যায়। ১৬ আগস্ট সকালে রেডিওতে যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারিত হয় তখন বঙ্গবন্ধুর প্রায় সকল আস্থাভাজন অনুসারীরা কচুরিপানার মতোই স্রোতের সঙ্গে গা ভাসান। সবাই ভাবেন- বঙ্গবন্ধুই যখন নেই তখন কী হবে প্রতিবাদ করে আর নিজের জীবন বিপন্ন করে? এরচেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করে বরং ঘাতক সরকারের সাথে আঁতাত করা এবং নিজেকে নিরাপদ রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। অতএব, বুদ্ধিমান গণেশরা রাতারাতি সবাই উল্টে গেলেন!

শুধু উল্টাতে পারলেন না সিরাজ উদদীন আহমেদের মতো নীতিবান কিছু মানুষ। তারা প্রতিবাদ করে বসলেন। খুনি মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে বসলেন। তৎকালীন বরগুনা মহকুমার প্রশাসক হিসেবে সিরাজ উদদীন আহমেদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪ দিন পরেও খুনি সরকারের বশ্যতা স্বীকার না করে উল্টো বরগুনায় বঙ্গবন্ধুর শাসন অটুট রেখেছিলেন। বরগুনার মুজিববাহিনী মুক্তিযোদ্ধা, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও আপামর ছাত্র-শিক্ষক-জনতাকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে নেমেছিলেন রাজপথে। মোশতাক সরকারের সমস্ত আদেশ-নির্দেশ প্রত্যাখান করে বরগুনা মহকুমাকে (জেলা) কয়েকদিনের জন্য গোটা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন এই দুঃসাহসী বীরযোদ্ধা।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তীকালে বিভিন্ন গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক-২০২২’-এ ভূষিত হয়েছেন বাবুগঞ্জ উপজেলার কৃতি সন্তান এই কীর্তিমান পুরুষ। আমাদের দেশে জীবদ্দশায় মানুষের কর্মের মূল্যায়ন খুব একটা হয় না। খুব বিরল ক্ষেত্রেই কর্মবীররা নিজের জীবদ্দশায় তার কর্মের মূল্যায়ন দেখে যেতে পারেন। যারা পারেন তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। তাই দেরিতে হলেও কর্মবীর সিরাজ উদদীন আহমেদকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে, জীবদ্দশাতেই প্রাপ্য সম্মান দিয়েছে এজন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

২৪ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ করেছেন দেশের এই জীবন্ত ইতিহাস, জীবন্ত কিংবদন্তি সিরাজ উদদীন আহমেদ। পদকপ্রাপ্ত সিরাজ উদদীন আহমেদকে মঞ্চে না ডেকে বরং মঞ্চ থেকে নিজেই নেমে এসে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এমন বিরল শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন দেখে সবাই বেশ অবাক হন। গৌরবের আনন্দে আত্মহারা হন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিংবদন্তিরা বছর বছর জন্মান না। শতাব্দীতে দু’একজন আসেন। তাই সিরাজ উদদীন আহমেদ কিংবা হাজারেরও বেশি কিডনি প্রতিস্থাপনকারী প্রফেসর ডাঃ কামরুল ইসলামের মতো ইতিহাসের কিংবদন্তি কর্মবীরদের জীবদ্দশায় খুঁজে বের করে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের সম্মানিত করে আজ কিছুটা হলেও ইতিহাসের দায়মুক্তি হয়েছে বলে আমি মনে করি। #

লেখাঃ আরিফ আহমেদ মুন্না
সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকারকর্মী।

15 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন