২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

মর্দন ।। বিধান সরকার

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ, ১৯ মে ২০২০

বিধান সরকার: : ওই সময়টা এমন যখন কানাই বাবু প্রয়াত হয়েছেন। শ্যাম বাবুর জমিদারী বলতে বাড়িটি বিক্রির অপেক্ষা করছেন। বেণী বাবু কাজের বেটি বিয়ে করে সমাজ কর্ম থেকে দূরে রয়েছেন। বিশ্বনাথ ঘোষ সুরা খেয়ে কেবল নিজের কথাটি বলে কেটে পড়েন। আর সাত ভাইয়াদের জৌলুস কমে কোন মতে টিকে আছেন। এমন সময়ে সমাজের মধ্যে ঢুকে পড়েন উঠতি পয়সাওয়ালা এলোদাঁতের পান খাওয়া হাঁপানি রোগী বিজয় কামার। রাষ্ট্রের প্রশাসনের সাথে মেশা বা কথা বলা ও জায়গাতে সে বেমানান। তখন বিজয় কামারকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে ওঠে। সে জানে তার গ্যাটে বিদ্যার ছোঁয়া নেই বটে, তবে পেছন পথে টিকে থাকার বুদ্ধি যথেষ্ট আছে। এটাকে লোকে কুটবুদ্ধি বা দুষ্টবুদ্ধি বলে বেড়ালেও এনিয়ে বিজয় কামার উল্টো গর্ববোধ করেন। সব মিলিয়ে মনে করেন ঈশ্বরের কৃপা হয়েছে তার প্রতি। এই সময়ে তার প্রতিপক্ষ রাম বাবুও নিজ থেকে ধর্ম বলেন, সমাজকর্ম বলেন এসব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এনিয়ে ভেবে বিজয় কামার উৎফুল্ল হয় কখনোবা- কিচ্ছু পারেনি রাম বাবু। তার দুই পুত্রকে পড়ালেখা করালো বটেক, কিন্তু চাকুরী পেলোনা এখনো। বড়টার দেখি মাথার চুল সামনে থেকে পাতলা হয়ে যাচ্ছে তবুও বিয়ে করাতে পারলো কই। উপযুক্ত পাত্রী চাই, ছেলে তানার ইঞ্জিনিয়রিং পাশ দিয়েছে যে।

এমন তাচ্ছিল্যের ভাবনায় আরেক উপমা আসে প্রায় সময়। নারায়ণ মন্ডলের ছেলে মানিক, যেমন নাম তেমন দেখতে। একবারেই পাশ করে চাকুরী পেল। ছেলে পড়ার খরচ যোগাতে রাম বাবুর কাছেই স্ত্রীর সোনার গয়না বন্ধক রেখেছিলেন নারায়ণ মন্ডল। রাম বাবু বলেছিল-
গয়না ছাড়াতে সুদের টাকা দিতে হবে না। আমার একমাত্র কন্যা উমাকে মানিকের জন্য ভেবে রেখেছিলাম, ক্যামন হয়?

নারায়ণ মন্ডল সুদ সমেত আসল টাকা দিয়ে গয়না ছাড়িয়ে নিলেন। আর জবাবে বলেছিলেন-

দাদা আমি বল্লেই কি আর হলো, ওতো নির্ভর করবে ছেলের ওপর।

এই কথাটি নারায়ণ মন্ডল সরাসরি বলে দেয়ায়, যা মনে করে সুখ অনুভব করেন বিজয় কামার। আরো ভালোলাগে উপমা টেনে মনে মনে আওরায়-

আমার দুই ছেলেকে অত বেশী লেখাপড়া করালে ওরাওতো চাকুরী না পেয়ে বেকার বইসে থাকতো। তার চেয়ে এই ঢের করেছি, বাপ দাদার পেশায় নামিয়েছি। ওরা এখন বেইশ আছে বন্ধকী কারবার করে, বৌ-ছেলেপুলে নিয়ে। কই আমার মেয়েটারেওতো স্বজাতের অবস্থাপন্ন কারবারির সাথে পাত্রস্থ করেছি। রাম বাবুর মত ভিন জাতের কতা শুইনতে হয়নি। আমার জামাইখানিকি মানিকের চেয়ে কম কিছুর? সরকারী চাকুরীর গুল মারি। ক’টাকা কামাই?

এমন কত কথা ভেবে ভেবে পুলকিত হয় বিজয় কামার। সমাজে দান নিজেই করেন। আর প্রয়োজনে প্রশাসনের বখরা পাঠান বড় ছেলের দ্বারা। যেকিনা মাধ্যমিক পাস দিয়েছে। আর কি চাই ঈশ্বরের পানে? তবে আছে; আরো অতৃপ্ত বাসনা আছে বিজয় কামারের মনে। তাই সামনের পানেই ছুটছি।

পেটের তাগিদে আজ থেকে দুই কুড়ি বছর আগে কোটালিপাড়া থেকে এই নামা অঞ্চলে এসেছিল বিজয় কামার। তাগড়া জোয়ান, সবে বিয়ে করা বৌ সাথে নিয়ে একখানা পুটলি সমেত উপস্থিতি। বাজারের দক্ষিণ সারির শেষ মাথায় খোন্দকারদের টিনের দোচালা ঘরটি ভাড়ায় নিয়েছিলেন। এক মাথায় বৌ নিয়ে সংসার, আরেক মাথায় নিজ কম্মের হাতিয়ার জোগাড় করে দোকান খুলে বসা। ওসময় বাজারে পুরানো আরো দু’খানা স্যাকরার দোকান ছিল। তারা গহনার ডিজাইনে নতুনত্ব আনার বিপরীতে সুদের কারবারে বেশ জোর দিয়েছিলেন। প্রথমেই জমাদার বাড়ির বড় মেয়ে শেফালীর জন্য সুচিত্রা রিং বানিয়ে সুনাম কুড়ালো বিজয় কামার। স্কুলে গেলে অন্য মেয়েরা নেড়ে দেখে জানতে চায়, কোথা থেকে আনা? দেশের বাইরের বৈকি!

শেফালীর জবাব- আরে না, এতো আমাদের বাজারের পুকুর ধারে, নতুন যে স্যাকরা বসেছে ওর কাছ থেকে বানানো।

এই হলো; অন্য মেয়েরাও বাড়িতে গিয়ে বায়না ধরে। মায়েদের গোপনে জমানো ধান বিক্রির টাকায় ক্রেতার ভিড় বড়তে থাকলো বিজয় কামারের দোকানে। বাড়তি সুবিধা হলো ঘর আর দোকানের মধ্যে পার্থক্য বলতে শাড়ি দিয়ে টানানো বেড়া থাকায়। কাস্টমার দেখলেই ওই শাড়ি টেনে পাশ দিয়ে বিজয়ের বউ মুখখানি তুলে ধরে। নারীদের পেলে কখনোবা হাত ধরে ভিতরে নিয়ে বসায়। কত কথা বলে-

আমার সোয়ামী অনেক কাজ জানে, বুঝলে। দেশের বাড়ি জমিদার গিন্নীদের গহনা বানিয়েছে। একবার পূজোয় কোলকাতা থেকে জমিদারের নাতনী এসেছিল গো, বুঝেছো। ওর কানে চমৎকার রিং দেখেছিলেম। আর গলার চেইনখানি তাও দেখপার মত। হাতের বালায় কি কারুকাজ। ওই দেখেতো কামারকে এসে বললেম, অমন গহনা তুমি বানাতে পারো না বুঝি!

সোয়ামী বললে- দেকতে পেতাম যদি।

তো বড় পূজোর দিনে লোকের ভিড়ে ওই কনের দেখা মেলেনি। যেদিনে দশমী হলো, ওই দেবী বিসর্জন দেবার সময় সোয়ামী দেকা পেয়েছিল ওই কনের। এইতো,তারপরই আমরা চলে এলেম তোমাদের এইখানে। ওই রকম কোলকাতার ডিজেইন গড়তে আমার সোয়ামীর জুরি নেইগো।

নারী ক্রেতা পেলেই এমন গাল-গপ্পো কামার গিন্নীর। আর পুরুষ ক্রেতার উপস্থিতি টের পেলেই পর্দার ফাঁক গলে বক্ষের পাশ দিয়ে শাড়ি পেঁচানোর পর বের হওয়া অংস আর বদনখানির এক অংশ বের করে- ও দাদা ক্যামন আছেন। একখান পান দেবো কি?
কামার গিন্নির শ্যাম বর্ণের মাংসালো ওই অংস দেখে আর টোল পড়া গালের তির্জক হাসির উপস্থিতি কোন কোন ক্রেতা বিহ্বল হয়ে পড়তো। এনিয়ে কানাঘুসা করলো কেউবা, আর ক্রেতার সংখ্যাও বাড়তে থাকলো যথারীতি। একই সাথে বিজয় কামারের অবস্থার পরিবর্তন নাটকীয় হারে বৃদ্ধি পেলো। দোচালা ঘরখানি ছেড়ে দিয়ে সেমিপাকা ঘর ভাড়া নিলো। চোখ টাটানি শুরু হলো অন্য কামার গৃহস্তদের। টাকা হলে বুদ্ধি বাড়ে। যার প্রমাণ মিললো, সুযোগ বুঝে কামার গিন্নি বাজে লোক বলে খ্যাত আরজি খাঁকে বাপ ডেকে বসলো। এখন আরজি খাঁয়ের ছেলেদের সাথে বিজয় কামারের বেশ সখ্যতা বলতে, দুলাভাই বনে গেল। কেবল গয়না বানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; অন্য কামার গৃহস্তদের ন্যায় সুদের ব্যবসায় জাঁকিয়ে বসলো। দোকানে কর্মচারী বাড়লো। এরসাথে নিত্য সময় করে আরজি খাঁয়ের ছেলেদের সাথে পালাকরে মদ খাওয়াও শুরু করলো। আরজি খায়ের ছেলেদেরও সুবিধা হলো। দেড় টাকার মদ তিন টাকায় বিক্রি, সাথে খেতে পারে ফাও এমনি করেই দিন চলতে থাকলো। বললেই হলো কদ্দিন আর এমন করে চলা যায় বলো। সত্যিই বিজয় কামারের মনে অন্য বাসনা ভিড় জমালো।

মদ খেয়ে এসে একদিন রাতে বৌকে বললো-আরে বৌ তুইতো আগের মত পারছিস না যে। তোর নীচের পেটটা বেশ ভাড়ি হইয়েছে, চবর জমেছে বড্ড।

কামার গিন্নি শ্বাস চেপে ধরে উরু আরো প্রসারিত করে স্বামীকে জানান দিতে চায়, তোমায় সুখ দিতে প্রস্তুত আছি যে। ওতে আর কামারের মন ধরে না। তার মন পড়ে থাকে নদীর পাড়ের লাগোয়া আবাসে দারোয়ান কন্যা শোভার পানে। গৌরিক বরণ, হাসিতে মুক্তো ঝড়ে বৈকি! তবে শরীরে বইছে অনাহারে থাকার চিহ্ন। বিজয় কামার কোন এক দুপুরে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে শোভার মুখখানি আর অবয়বের কথা। অপুষ্টিতে বক্ষ দুটি সিঙ্গারা সাইজের বটে। ওই ভালো। পয়সা পেলে আর ঠিকমত খেতে পারলে বেশ হবে দেখতে। ওসময় নিজ থেকেই চোখ মুদে শোভাকে সামনে এনে দুই হাতে বক্ষ পিষে দিয়ে, কখনোবা মুখ লাগিয়ে ক’দিনের মধ্যেই যেন চৌত্রিশ সাইজ বানায়ে ছাড়ল। এক্কেবারে নয়া মাল। ঠোঁট চেপে ধরে নীচে একটা বালিশ গুঁজে দিয়ে তবেই কোমড় দোলাতে হবে। তাও আবার অলতো করে যেন ক্লেশ না হয় বাছার। এমন সময় গিন্নির স্পর্শে ঘুম ভাঙ্গে বিজয় কামারের। সুখের ভাবনায় ছেদ; খুন চেপে বসে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় কামার গিন্নিকে সুখ নিদ্রায় চিড় ধরানোর জন্য। একথা চলে যায় আরজি খাঁয়ের কাছে। তিনি এসে বিজয় কামারকে শাসিয়ে যায়-

দেখো কামার, আমার মাইয়ের কোন অসুবিধে হয় তাহলে তোমাকে ছাড়ছিনা কিন্তু।

ওসময় মাথা নিচু করে থাকে বিজয় কামার। তবে ওর ক’দিন বাদে মদপ্য অবস্থায় শোভার কথা তোলে আরজি খাঁয়ের সবচেয়ে নটোরিয়াস ছেলেটির সাথে। পাছে পয়সা হাতাতে পারবে বলে নটোরিয়াস ছেলেটিও সায় যোগায়-

কও কি দুলাভাই, শোভারে তোমার মনে ধরছে। চিন্তা কইরো না সুযোগ বুইঝা একদিন তোমারে ওঘরে ঢুকায়ে দিমু। একবার মান ভাঙ্গতে পারলেই হইবে, বাদবাকি আমি বুঝমু। ওর বাপেরে কমু কিচ্ছু করার নাই, মাইয়া তোমার ভালো থাকবে, তোমারও আর রাইত জাইগা পাহাড়া দিতে হইবে না।

কামারের চোখ চকচক করে ওঠে। মুখ ফুলিয়ে পাইপে বাতাস দিয়ে যেমন নতুন ডিজাইনের গহনা বানিয়ে আনন্দ পায়, তেমনটা এসে ভড় করে মনে। দুই বাচ্চা বিয়ানো বউটার শরীর অটুট থাকলেও নিচের দিকটায় আগের মত মাস্তি পায় না সে। তাই কোন এক দুপুরে বাজার যখন ফাঁকা, অমনি সময়ে দারোয়ানের বাড়ির পানে ছোটে। সাথে থাকা মদের বোতলে চুমুক দিয়ে বাকিটা আরজি খাঁয়ের নটোরিয়াস ছেলেটির হাতে ধরায়ে বলে- টানো শালা। অবশ্য এর আগে আরজি খাঁয়ের ছেলেটি রেকি করে গিয়েছিল, ঘরে কেবল দারোয়ান কন্যা শোভা ব্যতীত অন্য কেউ নেই যে।

দরজায় কড়া নাড়ে। শোভা এসে দরজা খুলতেই মুখ চেপে ধরে ভিতরে নিয়ে চলে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ছুটি গিয়ে শোভা ডাক চিৎকার করতে থাকে। লোকজন আসার টের পেয়ে দৌড়ে পালায় আরজি খাঁয়ের ছেলেটি, আর বিজয় কামার ঝাঁপ দেয় নদীতে। মাতাল অবস্থায় ডুবতে যাওয়ার উপক্রম দেখে লোকজনের অনুরোধে জেলে নৌকার মাল্লা, টেনে তুলে বিজয় কামারকে। খবরটি রাষ্ট্র হলে বাজার কমিটির লোকজন আসে। সন্ধ্যার পর বিচার বসে। কামার গিন্নির অনুরোধে জামাইয়ের মান বাঁচাতে বাজে লোক খ্যাত আরজি খাঁ এসে উপস্থিত হয়। কামারের এমন ঘটনায় ধিক্কার জানাতে থাকে সবাই। প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে মাথা মুড়িয়ে, আর মন্দিরে গুনতে হবে জরিমানার টাকা। এই সুযোগে বাজারের অন্য স্যাকরাদের এক ছেলে পুরানো ঝাল মেটাতে ময়রার দোকান থেকে ঘোল এনে ঢেলে দেয় বিজয় কামারের মাথায়। আর যায় কোথায়, এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও মোক্ষম সময় ভেবে হুংকার ছেড়ে ওঠে আরজি খাঁ। বলে-

চুতমারানীর পো, তোর মার হ্যাডা ভাইঙ্গা দিমু। এ আমার পোলারা কই? ধর, হালার পো হালারে ধর, শালিশদারদের অপমান! ওডো সবাই, বিচার হইয়া গেছে।

এযাত্রায় বিজয় কামার রক্ষা পায়। কামার গিন্নি প্রসন্ন হয়ে আরজি খাঁ ও তার ছেলেদের দাওয়াত করে ঘটা করে খাইয়ে দেয়। এমন করে চলতে থাকে কিছু কাল। জমি হয় কামারের। চারতলা ভবন হাঁকায়ে ফেলে ওই বাজারে। যা অনেকের কাছে আলাদিনের চেরাগ বলে ঘুরপাক খায়। কেউবা বলে দাও মেরেছে কামার। গহনা বানাতে গেলে খাদের পরিমাণ বাড়তি দেয়, সোনা চুরি করে সাথে সুদের ব্যবসাতো আছেই। যে যা বলেন নির্বিকার বিজয় কামার। সে চলে তার আপন খেয়ালে। কথা বলেন কেবল নিজের সাথে। পছন্দ এবং প্রয়োজনে দান করতে শুরু করেন। বাজারের সার্বজনীন হরিগৃহখানিকে দো চালা থেকে আট চালায় রূপান্তরিত করেন। চারদিকে ধন্য ধন্য রব ওঠে। বিশেষ করে দেহাতীরা আগের চেয়ে বেশী করে মান্য করতে থাকে। মন্দির কমিটির ভোটের বেলায় এতদিন উপেক্ষিত দেহাতীদের সুযোগ বুঝে সদস্য করে নেয় বিজয় কামার। দুর্গা পূজার অষ্টমির রাতে মদ খেয়ে টাল হয়ে কামারের ভিন্ন দেহভঙ্গীর নৃত্য, বৌ ঝিদের কাছে হাসির উপাদান হয়। পূজারী চরণামৃতের জল খাইয়ে বাড়তি আশীর্বাদ দিয়ে কামারকে আলাদা যোগ্যতার আসনে পাকাপোক্ত করে। ওই দেখে পাছে কেউ ছি ছি করলেও কিচ্ছু করার থাকে না। ভাবে দিন বদলে গেছে। কানাই বাবু গত হয়েছেন, বেনী বাবুও এমুখো হন না, যাও থাকার রাম বাবু সেও আপনামুখো হয়েছেন, আর শ্যাম বাবুর কথা কি বলবো সেতো দাদুর পাওয়া জমি-জিরত বেঁচে নিভু নিভু অবস্থায়। তাই এখন বিজয় কামার বৈ আর কে আছে দুম করে দশ-কুড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার ফেলে দেয়ার। ওই করেই চুপশে যায় সবাই। সুযোগে বিজয় কামারও জেঁকে বসে, হয়ে উঠেন সমাজের মধ্যমনি। মন্দিরের পূজারী সমঝে চলে কামারকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সবার মধ্যিখানে আসন পেতে দেয়। এই সুযোগে কামারও বিরহের গান বা ছন্দের তালে আধো বোজা চোখে সুন্দরীদের পরখ করে নেয়। আর মাঝ বসয়ী বা বৃদ্ধ নারীরা আবেগপ্লুত হয়ে কখনোবা কোল পেতে দেয়। ওসময় বিজয় কামারও দুহাত তুলে হা-হা করে কান্নার ঢঙ তুলে নারীদের সাথে কোকাকুলি করে চরণে হাত বুলিয়ে কপালে ঠেকায়।

এনিয়েও কত কথা হয়। আরে যৌবনে কামার শোভার ঘরে গিয়ে ভুল করেছিল বটে; এখন কি আর সেই অবস্থায় আছে? ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নাতি হয়েছে। ধর্ম-কর্মে মন দিয়েছে। তবে একটি কথা বেরিয়ে পড়েছিল রমেশের বউয়ের মুখ থেকে। ওই বার কীর্তনে রাধারাণীর দল আনা হয়েছিল বাড়তি টাকা গুনে। থাকতে দিয়েছিল রমেশের আবাসে। কৃষ্ণ বিরহের পালা। দলের প্রধান গায়েন রাধারাণী, গৌরিক বরণ চওড়া ছাতি। হা কৃষ্ণ বলে লুটিয়ে পড়লো জমিনে। ভক্তরা সব হই হই করে আওয়াজ তুললো। নারীরা সবে দিল উলুধ্বনি। ওই সুযোগে বিরহে কারত ভাব ধরে বিজয় কামার রাধারাণীকে তুলে কোল দিল। স্বজ্ঞানেই গন্ডদেশে চুমু খেলো, আর কোল ছাড়ানোর বেলায় বক্ষজোড়ায় চাপ দিয়েছিল। আসর ভর্তি লোক, হতবাক রাধারাণীর মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এসেছিল-অসভ্য ব্যাটা। এই কথা রাধারাণীই রমেশের বউকে বলেছিলেন। কথপোকথনে উপস্থিত স্বামী পরিত্যক্ত প্রমিলা দেবী বলে-

নচ্ছার ব্যাটা ওই কম্ম আমার সাথেও করেছিল যে। ঘেন্না লাগে, ইচ্ছা হয়েছিল মুখে কইষে একখানি চর বসাই। তা আসর ভর্তি লোক আর নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে পারলাম কই। আরো শোনবা? হরি মালাকরের মায়ের সাথেও অমন করেছে ঢ্যামনা ব্যাটা। লজ্জায় মরে যাই। তয় বুড়ির চেহার কিন্তু বয়সের ছাপ পড়েনি আর অই দুইডাতো চুপসে গিয়ে সুন্দর সাইজ হইছে। কাচুলি বান্ধা লাগেনা। মাঝখানে রমেশের বউ বলে ওঠে-

বুড়ির ওদুইডা দেখে কামারের মাথা গরম হইয়েছিল বোধ করি। দেখোনা ঠোঁট দুইটা ক্যামন সিঁদুর রঙা। তয় কামারের তো বয়স হইছে, এখন যা করে ওসব স্বভাবের দোষ। এই কথায় প্রমিলা দেবীর উত্তর আসে-

পুরুষের আবার বয়স লাগে? শুইনেছি নব্বই বছরেও বাচ্চা পয়দা করতে পারে। তা যাই করো বউ, তুমি আবার কামাররে কোল দিতে যাইওনা। এমন বলে হাসির রোল উঠে কথোপকথনকালে।

বিজয় কামারের যৌবন এখন অস্তরাগে বটে। এসময় অনুষ্ঠানে গিয়ে নারীদের কোল পেয়ে আর বক্ষদেশ টিপে দিয়ে শরীরে পুলকিত বোধ করেন। পর্যায়ক্রমে যা অভ্যাসে পরিণত হয়। পাছের কথায় সে আমল দেয়নি কখনোই। সামনে চলাই তার লক্ষ্য। এজন্য সে মুখিয়ে থাকে কোথায় কীর্তন অনুষ্ঠান আছে। যুঁতসই মনে করলে চাঁদার পরিমাণ তিন গুনও দিয়ে ফেলে। এজন্য ওসব এলাকার মান্য লোকেরা বিজয় কামারকে বাড়তি আপ্যায়ন বা সমীহ করে সামনের কাতারেই স্থান দিয়ে থাকে।

এখন আর ওই অবস্থা আছে কিনা খুব একটা জানিনে। তখন ফি বছর হয় দুর্গা পূজা, নতুবা শীতের শেষে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কনেদের বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা অবধারিত ছিলো। কারোর পতিধন আসতে না পরলেও সন্তান সমেত, নতুবা বাবার বাড়ি থেকে আসা লোকের সাথে পাঠিয়ে দিত। ওবার অনেকটা কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই মনোরঞ্জন শীলের দলটির নাগাল পাওয়া গিয়েছিল। দলের খরচতো আছেই, তারওপর প্রতি আসরে শীলজীকে হাজার এক টাকা বকশিশ দিতে হতো। খাবার বেলায় এক বাটি দুধের সর। ওসব কোন বিষয় নয়; বিজয় কামারের নির্দেশ, যত খরচই হোক এবার মনোরঞ্জন শীলের দলটিকে তাদের চাই। ঘটা করে প্রচার করা হলো কোন কোন দল আসছে এবার। আর কবি গানের জন্য আরজি খাঁয়ের মনেধরা যশোর থেকে আনা হচ্ছে অশোক সরকারকে।

চারদিকে হৈ হৈ রব। কীর্তন জমবে এবার। যথারীতি কনেরাও আসতে শুরু করলো বাবার বাড়িতে। মরোনঞ্জন শীলের দল নেমেছে সন্ধ্যা উতরে রাতে। মানুষের ঠাসাঠাসি। বিজয় কামার আসরের মধ্যমনি হয়ে আসন পেতেছেন যথারীতি। শীলজী গাইছেন বটে, সাথে দোহারের টান আরো মোহিত করে তুললো। যেন পুরো আসর জুড়ে কখনো নিরবতা আবার কখনো হাল্কা দোলে নিরবতা ভেঙ্গে খোলে তেহাই তোলে, যা আরো বিষাদ করে দেয় বেহেলার সুরে। লুটিয়ে পড়ে বয়স্য ভক্তগণ একে অপরের চরণ তলে। কেউবা ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। যুবক-যুবতীরাও অব্যক্ত কথা তুলে রেখে চুপচাপ থাকে। এমন পরিবেশ বিজয় কামারের জন্য অপেক্ষার মোক্ষম সময়। বেদনার্ত আবহাওয়া একে অপরের দিকে তাকানোর সময় কই। সবাই যেন ঈশ্বর সান্নিধ্যের ঘোরের মধ্যে। ওসময় বিজয় কামার তড়িৎ বেগে আসন ছেড়ে এক নারীকে কোল দিতে চলে। তার পুরানো অভ্যেস মত কাধ ছেড়ে দুই হাতে স্তন মর্দনের সময় নারীটি বেদনার্ত কন্ঠে বলে ওঠে-‘বাবা, করছোটা কি?’ চোখ তুলে দেখে নিজ কনে।

লেখক: ছোট গল্পকার ও সাংবাদিক

8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন